করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন গত ২৪ নভেম্বর শনাক্ত হয় সাউথ আফ্রিকায়। দ্রুত এটি ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, বতসোয়ানা, হংকং ও ইসরায়েলসহ বিশ্বের অনেক দেশে। যেসব দেশে এই ধরন পাওয়া গেছে সেসব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হতে পারে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে সাউথ আফ্রিকার সঙ্গে স্থগিত করা হয়েছে যোগাযোগ।
এমন প্রেক্ষাপটে আফ্রিকা অঞ্চল থেকে গত এক মাসে দেশে ফেরেন ২৪০ বাংলাদেশি। দেশের তিনটি বিমানবন্দর দিয়ে দেশে আসা এই বাংলাদেশিরা এসেছেন সাউথ আফ্রিকা, নামিবিয়া ও জিম্বাবুয়ে থেকে। কিন্তু তারা এখনও বাড়ি ফেরেননি। আর এতেই শঙ্কিত করোনা কমিটি।
সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশে আসা ২৪০ জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
মন্ত্রী বলেন, ডেল্টার চেয়েও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন। ওমিক্রনের সংক্রমণ রোধে সরকার সতর্ক অবস্থানে আছে। তবে দুঃখের বিষয় গত এক মাসে ২৪০ জন আফ্রিকা থেকে এসেছেন। এখন তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের ফোনও বন্ধ।
মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) দুপুরে সচিবালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী এই তথ্য জানান।
তিনি বলেন, আফ্রিকা মহাদেশ থেকে আসতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। যদি আসে তাহলে ১৪ দিনের কঠোর কোয়ারেন্টাইন অবশ্যই মানতে হবে। কর্তৃপক্ষকে বলবো, বিদেশ থেকে যারা আসবে, তাদের যেন মনিটরিং করা হয়।
জাহিদ মালেক বলেন, সীমান্তে কঠোর কড়াকড়ি আরোপ করা হবে। সব জেলায় চিঠি দেওয়া হবে। সংক্রমণ ঠেকাতে সব ধরনের সামাজিক রাজনৈতিক অনুষ্ঠান সীমিত করতে হবে।
তবে দেশের করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগের চেয়ে সক্ষমতা বেড়েছে বলেও জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
সম্প্রতি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে যারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসেছেন, তারা যেভাবে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা বাড়িতে চলে গেলেন; এ রকম যদি ওসব দেশ থেকে আরও লোকজন আসে তাহলে কি তারা সরাসরি বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থাকবেন নাকি ব্যবস্থা নেওয়া হবে— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ওরা তো আগে চলে গেছে বাড়িতে। আমরা তো ওমিক্রন সম্বন্ধে জানলামই সাত দিন হলো। সব কিছু বলার আগেই তো ওখানে চলে গেছে। এর মধ্যেও আমরা ডিজি হেলথকে নির্দেশনা দিয়েছিলাম। তারা ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। ন্যাশনাল টেকনিক্যাল কমিটিও পরামর্শ দিয়েছে।
আফ্রিকা থেকে আসা লোকজনের ভুল ঠিকানা দেওয়াতেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এই যে লোকজন আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। আমরা অ্যাড্রেস করতে পারছি না। তারা ওই দেশ থেকে এসেছে, মোবাইল ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে, ভুল ঠিকানা দিয়েছে— এই জিনিসগুলো কী রকম! এ জন্য আমরা ওই সব দেশ থেকে আসা লোকজনের ব্যাপারে বেশি কড়াকড়ি করবো। যারা আফ্রিকান দেশগুলো থেকে আসবে তাদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন তো থাকবেই। আমরা ওখান থেকে আসতেই নিরুৎসাহিত করবো।’
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে আফ্রিকা ফেরত ৭ বাংলাদেশির বাড়িতে লাল পতাকা টাঙানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা করোনা কমিটি। পাশাপাশি আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে যাত্রী পারাপারে নজরদারি ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার নির্দেশ জারি হয়েছে।
জেলার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ একরামুল্লাহ বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি চিঠিতে জানতে পারি, আফ্রিকা অঞ্চল থেকে ৭ জন সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন। তাদের তিনজন কসবার, দুইজন সদর উপজেলায়, বাঞ্ছারামপুরের একজন ও নবীনগরে একজনের বাড়ি। তারা বাড়ি ফিরেছে কী না তা খতিয়ে দেখবে পুলিশের বিশেষ টিম।’
সিভিল সার্জন আরও বলেন, ‘বাড়ি এলে সবাইকে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। কারও উপসর্গ থাকলে, দ্রুত পরীক্ষা করাতে হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে এসব বাড়িতে লাল পতাকা টাঙিয়ে দেয়া হবে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কোভিড-১৯-এর এখন পর্যন্ত যতগুলো ধরন আছে তার মধ্যে ওমিক্রন সবচেয়ে জটিল, বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ ছড়ানো ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মতোই।
৬০ বছরের বেশি বয়সীরা পাবেন বুস্টার ডোজ
এদিকে ৬০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিকে করোনা টিকার বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন আলাপ-আলোচনা করে কবে থেকে তা দেওয়া হবে, সেই দিনক্ষণ ঠিক করা হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এ তথ্য জানিয়েছেন।
৬০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিকে করোনা টিকার বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন আলাপ-আলোচনা করে কবে থেকে তা দেওয়া হবে, সেই দিনক্ষণ ঠিক করা হবে।
করোনায় সংক্রমিত হলে মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের। এজন্য এই বয়সী জনগোষ্ঠীকে টিকার বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আমরা জানি, করোনায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন বয়স্করা। তাই ৬০ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে।
জাহিদ মালেক বলেন, নো মাস্ক নো সার্ভিস নয়, এখন সরকার বলতে চায়, ‘নো ভ্যাকসিন নো সার্ভিস’।
মন্ত্রী বলেন, স্কুল-কলেজ যে অবস্থায় আছে সেভাবেই থাকবে। আর যেন সময় বা ক্লাসের দিন বাড়ানো না হয়।
ওমিক্রন ঠেকাতে সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি গণজমায়েত না করতে অনুরোধ জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দেশে করোনার প্রকোপ কমায় যে ঢিলেঢালাভাব চলে এসেছে তা নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে।
করোনা প্রতিরোধে দুই ডোজের টিকা নিয়েছেন এমন অনেকেরই ছয় মাস পেরিয়েছে, যাদের শরীরের অ্যান্টিবডি অনেকটাই কমে এসেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী করোনার নতুন নতুন ধরনও দেশে সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা তৈরি করছে। এই অবস্থায় বয়স্ক ও কোমরবিডিটিতে আক্রান্ত রোগীদের সংক্রমণ ঠেকাতে বুস্টার ডোজ প্রয়োগে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বুস্টার ডোজ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন অনলাইনভিত্তিক এক দৈনিককে বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু মানুষকে বুস্টার ডোজ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে এই মুহূর্তে বুস্টার ডোজ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যারা একদম টিকা পায়নি তাদের এই মুহূর্তে টিকার আওতায় আনা জরুরি। নির্দিষ্ট সবাইকে টিকা দেওয়ার পর আরও উন্নত সংস্করণের টিকা আসবে, তখন বুস্টার ডোজ দেওয়া যাবে।
তিনি বলেন, আমরা দেখি যে অনেকেরই কোমরবিডিটি কন্ডিশন থাকে, এছাড়া বয়স্কদের ক্ষেত্রে যাদের চিকিৎসকের বুস্টার ডোজের ব্যাপারে সুপারিশ থাকে, তাদেরকে দেওয়া যেতে পারে। কোনো একজন লোকের দেখা গেল যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কমে গেছে, এক কথায় তার ক্লিনিক্যাল কন্ডিশনের কারণে যদি বুস্টার ডোজের প্রয়োজন হয়, শুধু তাকেই দেওয়া যেতে পারে। কারণ করোনায় তাদের মৃত্যুহার অনেক বেশি।
এদিকে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের সম্ভাব্য সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রস্তুতি হিসেবে ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা, রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা জোরদার, জনস্বাস্থ্য উদ্যোগ গ্রহণ ও প্রচার-প্রচারণা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
২৬ নভেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওমিক্রনকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ বা উদ্বেগজনক ধরন বলে ঘোষণা করে। গত রোববার একে বিশ্বের জন্য অতি উচ্চ ঝুঁকির বলে উল্লেখ করে সংস্থাটি। এ ধরনের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করছে বলে গণমাধ্যমে খবর বের হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনার নতুন এ ধরনের অস্তিত্ব সম্পর্কে কেউ কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ