ইহুদি ধর্মীয় উৎসব হানুকা উদযাপন উপলক্ষে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট ফিলিস্তিনের প্রাচীন শহর হেবরনে ঐতিহাসিক ইব্রাহীমি মসজিদে আসেন। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে মসজিদে এসে হানুকার আলোক প্রজ্জ্বলন করেন তিনি। আইজ্যাক হ্যারজগের মসজিদে এসে হানুকার উদযাপনের সমালোচনা করছে ফিলিস্তিনিরাসহ আরব লীগ ও ওআইসি।
পশ্চিম তীরের হেবরনের ইবরাহীমি মসজিদের কাছে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর কবর থাকায় ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলাম; তিন ধর্মের লোকেরাই একে পবিত্রস্থান হিসেবে গণ্য করে। ইবরাহীম (আ.) কে তিন ধর্মের অনুসারীরাই তাদের পূর্বপুরুষ হিসেবে বিবেচনা করে।
গত রোববার সন্ধ্যায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট স্থানীয় অবৈধ ইহুদি বসতকারী ও কট্টপন্থি ইহুদি এমপিদের নিয়ে ঐতিহাসিক ওই মসজিদটিতে ঢুকে পড়েন। সেখানে ইহুদি উৎসব হানুকা উপলক্ষ্যে তিনি মোমবাতি জ্বালান। এ সময় আশপাশের সব দোকানপাট বন্ধ করে দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। এমনকি সাংবাদিকদেরও ইসরায়েলি প্রেসিডেন্টের অনুপ্রবেশের খবর তথ্য সংগ্রহে বাধা দেওয়া হয়।
আইজ্যাক হ্যারজগ ইবরাহীমি মসজিদে হানুকা উৎসবের আলোক প্রজ্জ্বলনের অনুষ্ঠানে বলেন, হেবরনের ‘কেভ অব দ্য প্যার্টিয়ার্কে’ তার ভ্রমণের উদ্দেশ্য এই প্রাচীন শহরের ইহুদি অতীত উদযাপন ও আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক বাড়ানো।
ইবরাহীমি মসজিদ ইহুদিদের কাছে ‘কেভ অব দ্য প্যার্টিয়ার্ক’ (ধর্মীয় প্রধানদের গুহা) হিসেবে পরিচিত।
বক্তব্যে হ্যারজগ হেবরন শহরে চলমান ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও ইহুদি বসতিস্থাপনকারীদের স্থানীয় ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের ওপর আক্রমণের বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শাসনামলে হেবরনে এক দাঙ্গায় নিহত ইহুদি বাসিন্দাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। হেবরনের ওই দাঙ্গায় ৬০ ইহুদি নিহত হয়েছিলো।
ওই দাঙ্গা থেকে তার এক আত্মীয় বেঁচে গিয়েছিলেন উল্লেখ করে হ্যারজগ বলেন, ‘আমার কোনো সন্দেহ নেই যে তার এক অধ্বস্তন পুরুষ ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কেভ অব দ্য প্যার্টিয়ার্কে হানুকার আলোক প্রজ্জ্বলন করছে দেখে তিনি প্রশান্তি লাভ করতেন।’
শহরের ইসরায়েলি বসতিকে ‘সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ইসরায়েলি নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বর্তমানে হেবরনে প্রায় এক হাজার বসতিস্থাপনকারী বাস করছেন। অপরদিকে শহরের দুই লাখ ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি সৈন্যদের বন্দুকের নলের মুখে জীবনযাপন করছেন।
এদিকে সোমবার এক বিবৃতিতে জেদ্দাভিত্তিক মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সংস্থা ওআইসি এ ন্যক্কারজনক ধর্মবিদ্বেষী আচরণের গভীর নিন্দা জানিয়েছে।
ওআইসির বিবৃতিতে বলা হয়, মুসলিমদের আবেগ ও অনুভূতিতে আঘাত দিতে ইহুদিবাদী এ রাষ্ট্রপতি পবিত্র মসজিদে অনুপ্রবেশ করেছেন।
এর আগে ইব্রাহীমি মসজিদে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্টের অনুপ্রবেশের ঘটনায় এক বিবৃতিতে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আরব লীগ।
এদিকে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সিনিয়র ধর্মীয় উপদেষ্টা ইসরায়েলের প্রেসিডেন্টের ইব্রাহীমি মসজিদে যাওয়ার নিন্দা জানিয়েছেন।
মিডেল ইস্ট মনিটরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সিনিয়র ধর্মীয় উপদেষ্টা ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হ্যারজগের ইব্রাহীমি মসজিদে যাওয়ার নিন্দা জানিয়েছেন। হ্যারজগের সঙ্গে ইসরায়েলের সেনারাও ছিল। এটিকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট আগ্রাসন বলেও অভিহিত করা হয়।
পিএ কর্মকর্তা জোর দিয়ে বলেন, অন্যান্য ঐতিহাসিক পবিত্র স্থান ও জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদের মতোই ইব্রাহীমি মসজিদের পবিত্র মর্যাদা রয়েছে। যা শুধু ফিলিস্তিনিদের ব্যবহারের জন্যই।
ইবরাহীমি মসজিদের পরিচালক হাফিজ আবু সিনিনা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, হ্যারজগের এই ভ্রমণ ইবরাহীমি মসজিদকে ইসরায়েলের দখল চেষ্টা এবং এর পরিচিতি পরিবর্তনেরই অংশ।
তিনি বলেন, ‘আমাদের পবিত্রস্থানে যা হচ্ছে, তা কোনো বিস্ময়কর ঘটনা নয়। মসজিদুল আকসা ও ইবরাহীমি মসজিদ ইসরায়েলি আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণের জন্যই ধারাবাহিক আক্রমণের অংশ হিসেবে এই ঘটনা ঘটছে।’
আবু সিনিনা বলেন, ‘আমরা ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের কমিটির কাছে এই অঞ্চলের অবস্থা সম্পর্কে জানিয়েছি, যেহেতু চার বছর আগে এই কমিটি ইবরাহীমি মসজিদকে ফিলিস্তিনি ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছিলো।’
অপরদিকে ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা হুসাইন আল-শেখ হ্যারজগের এই ভ্রমণকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ‘রাজনৈতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় উসকানি’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
অপরদিকে বিক্ষোভে অংশ নেয়া নুরিত বুডিনস্কি নামের এক ইসরায়েলি অধিকারকর্মী বলেন, ‘হ্যারজগের কোনো লজ্জা নেই। তিনি ওই ইহুদিদের সাথে স্বাধীনতার উৎসব পালন করতে এসেছেন, যারা শহরটি দখল করেছে। হেবরনে কোনো স্বাধীনতা নেই। এখানে জনগণ অসহ্য দখলদারিত্বের মধ্যে বাস করছে।’
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে ফিলিস্তিনে গ্রিক শাসনামলে ইহুদি ধর্ম পালন নিষিদ্ধ হলে ইহুদিরা যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের ধর্ম পালনের অধিকার আদায় করে। এর স্মরণেই হানুকা উৎসব পালন করা হয়।
এদিকে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরোধী সাবেক ইসরায়েলি সৈন্যদের সংগঠন ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স জানিয়েছে, হ্যারজগের এই ভ্রমণ এই অঞ্চলের নির্মম বাস্তবতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর পশ্চিম তীরে সাথেই হেবরন শহর ইসরায়েলি দখলে আসে। হেবরন দখলের পর ইসরায়েল এই শহরে অবৈধ বসতি স্থাপন করে এবং ইবরাহীমি মসজিদ মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে দুই ভাগ করে দেয়।
১৯৯৩ সালে স্বাক্ষরিত অসলো চুক্তির আওতায় দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের অংশ হিসেবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে হেবরনসহ পশ্চিম তীর থেকে ইসরায়েলি বসতি সরিয়ে নিয়ে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়ার কথা থাকলেও ইসরায়েল এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
২০১৭ সালে ইউনেসকো ইব্রাহীমি মসজিদসহ প্রাচীন হেবরন শহরকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে।
১৯৯৪ সালে উগ্রবাদী ইহুদিরা ইব্রাহীমি মসজিদে অনুপ্রবশ করে ২৯ মুসল্লিকে হত্যা করে। ফিলিস্তিনের প্রাচীন এ শহরটিতে ১ লাখ ৬০ হাজার মুসলিমের বসবাস। এখানে বিভিন্ন অবৈধ ৫০০ ইহুদির বসবাস। ইসরায়েলি বাহিনী এই ৫০০ ইহুদির নিরাপত্তার জন্য পুরো হেবরনের মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৯
আপনার মতামত জানানঃ