পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের পরপরই রাজ্য বিজেপিতে ভাঙনের ঢেউ লাগে। রাজ্য জয়ের স্বপ্ন দেখেছিল দলটি, কিন্তু ২০০ আসন জেতা তো দূর, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে কার্যত পর্যুদস্ত হয়েছে বিজেপি। আর তারপর থেকেই বিজেপি ছাড়ার হিড়িক পড়ে গিয়েছে।
এদিকে একের পর এক কংগ্রেস নেতা-নেত্রীকে নিজের দলে ভেড়াচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ নিয়ে দূরত্ব বাড়ছে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে। আবার একইভাবে চড়া হচ্ছে তার বিজেপিবিরোধী সুর।
একের পর এক উইকেট পড়ায় দেশের প্রাচীনতম দল কংগ্রেস ক্রমশই জাতীয় রাজনীতিতে তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে। অপরদিকে, বাংলার বুকে কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হওয়া তৃণমূল আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে দেশে বিজেপিবিরোধী রাজনীতিতে শক্ত অবস্থানে। আঞ্চলিক দলের তকমা ঝেড়ে তৃণমূল এখন সর্বভারতীয় হয়ে ওঠার পথে। চব্বিশের লোকসভা ভোটে মোদিবিরোধী জোটে সোনিয়া, রাহুল কিংবা প্রিয়াঙ্কা নন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এখন মুখ।
২০২৪ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি রাজ্যে তৃণমূল শুধু রাজনৈতিক শাখা বিস্তার নয়; বরং সংশ্লিষ্ট রাজ্যের প্রভাবশালী নেতৃত্বের হাতে তৃণমূল কংগ্রেসের দায়িত্ব দিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে জোর লড়াইয়ে নামারও ইঙ্গিত দিচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী।
দিল্লি সফরের প্রথম দিন থেকেই একের পর এক কংগ্রেস নেতা, সঙ্গীত শিল্পী এবং বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক মঞ্চের নেতাদের নিজের দলে যুক্ত করছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শুধু বিজেপি বিরোধী নয়, এখন বিজেপির অনেক বিক্ষুব্ধ নেতাকেই মমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে দেখা যাচ্ছে। এর প্রমাণ মিলল, মোদির সঙ্গে বৈঠক করার মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে বিজেপির প্রবীণ সদস্য সুব্রমানিয়ম স্বামী যখন নিজে গিয়ে মমতার সঙ্গে দেখা করেন এবং তার পাশে থাকার ইঙ্গিত দেন।
এর আগে মঙ্গলবার কীর্তি আজাদ, পবন বর্মা এবং অশোক তনওয়ারের মতো বিজেপি বিরোধী নেতাদের নিজের দলে যুক্ত করেন মমতা। এবার আরও বড় মাস্টার স্ট্রোক দিলেন মেঘালয়ের ১২ বিধায়কসহ সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমাওকে নিজের দলে যুক্ত করে পাবর্ত্য রাজ্য মেঘালয়ের শক্ত জমি তৈরি করলেন মমতা। রাজ্যটির বিধানসভায় ১৮ জন কংগ্রেস বিধায়ক ছিলেন। কংগ্রেস ছেড়ে ১২ জন বিধায়কই মমতার দলে নাম লেখানোয় সেখানে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসবে তৃণমূলই। ৬০ আসনের মেঘালয় বিধানসভা বিজেপির দখলে।
মমতার সফরের শেষ চতুর্থ দিনেও দিল্লির বড় কোনো রাজনৈতিক নেতাকে তৃণমূলে যোগ দিতে দেখা যেতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
সাধারণত কোন নির্বাচনের আগেই নামি-দামী ব্যক্তিদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোতে যোগ দিতে দেখা যায়, কিংবা এক দল ছেড়ে আরেক দলে যোগ দেওয়ার প্রবণতা চোখে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক প্রতিটি নির্বাচনেও এ চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে গত মার্চ-এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত বিধানসভার নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রায় প্রতিদিনই পালা করে রাজ্যটির ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়ক-কাউন্সিলর-পঞ্চায়েত প্রধান থেকে শুরু করে দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকরাও দলে দলে বিজেপিতে যোগ দিতে দেখা গেছে। দলবদলের হিড়িক দেখে অনেকেই মুচকি হেসে কটাক্ষ করেছিলেন যে তৃণমূল দল আদৌ থাকবে কি না!
গত ২ মে ভোটের ফল বের হয়, তাতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয়বারের মতো রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। এরপর সরকারও গড়ে তারা। কিন্তু ভোটপর্ব মিটলেও ফের দলবদলের হিড়িক! তবে এবার ছবিটা উল্টো! বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগদানের হিড়িক পড়েছে কলকাতা থেকে জেলায় জেলায়।
কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের সখ্যের পুঁজিকে বিরোধিতা করেই বাংলায় নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করে চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়েছিলেন মমতা। সেই অবস্থান ধরে রেখেই বাংলায় কংগ্রেসকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে তৃণমূল। ঠিক একইভাবে কেন্দ্রে মোদি সরকারকে উৎখাত করতে কংগ্রেস কতটা আন্তরিক সেই প্রশ্নকে সামনে রেখেই দেশের বিরোধী রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করছেন মমতা।
ভারতের কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির লক্ষ্য ছিল বিধানসভার নির্বাচনে ২০০ আসন পার করে ক্ষমতায় আসবে। আসন সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে ওই নির্বাচনে বাবুল সুপ্রিয়, লকেট চ্যাটার্জি, স্বপন দাশগুপ্ত, জগন্নাথ সরকার, নিশীথ প্রামানিকসহ কয়েকজন সংসদ সদস্যকে দাঁড় করিয়ে চমক দিয়েছিল গেরুয়া শিবির। কিন্তু ক্ষমতায় আসা তো দূরের কথা, মাত্র ৭৭ আসনে জয় পেয়েই তাদের বিজয় রথ থমকে যায়।
রাজ্যে ক্ষমতায় আসা হয়নি, এরই মধ্যে একের পর এক ধাক্কা বিজেপিতে। আগেই দল ছেড়েছেন মুকুল রায়সহ চার বিধায়ক। তারা ছাড়াও রীতিমতো চমকে দিয়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন বাবুল সুপ্রিয়।
সর্ব ভারতে ক্রমশ শক্তি বৃদ্ধি করে চলছে তৃণমূল। কংগ্রেসের অন্দরে ফাটল ধরিয়ে ত্রিপুরা, আসাম, গোয়া, হরিয়ানার পর মেঘালয় থেকে বিধায়করা কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছে।
শুধু কংগ্রেস নয়, অনেক আগেই বিজেপির প্রবীণ নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী যশবন্ত সিনহাও তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। সম্প্রতি বিজেপি নেতা সুধীন্দ্র কুলকার্নি ও জেডিইউ নেতা পবন বর্মা যোগ দেন তৃণমূলে।
গুঞ্জন রয়েছে,তৃণমূলে যোগ দিতে আরও একাধিক কংগ্রেস ও বিজেপি’র শীর্ষনেতা পাইপলাইনে রয়েছেন। দেশের দু’টি সর্ব বৃহৎ দল ভেঙে নেতাদের তৃণমূলে চলে যাওয়া অবশ্য অস্বস্তিতে ফেলছে কংগ্রেস-বিজেপিকে।
কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের সখ্যের পুঁজিকে বিরোধিতা করেই বাংলায় নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করে চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়েছিলেন মমতা। সেই অবস্থান ধরে রেখেই বাংলায় কংগ্রেসকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে তৃণমূল। ঠিক একইভাবে কেন্দ্রে মোদি সরকারকে উৎখাত করতে কংগ্রেস কতটা আন্তরিক সেই প্রশ্নকে সামনে রেখেই দেশের বিরোধী রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করছেন মমতা।
সম্প্রতি জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে তৃণমূল রাজ্যে রাজ্যে যে অবস্থান নিচ্ছে, তাতে স্পষ্ট হচ্ছে যে কংগ্রেসের বদলে তারাই প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠে আসতে চাইছে। একুশের বিধানসভা ভোটের পর থেকে একের পর এক কংগ্রেস নেতা তৃণমূলে যোগ দেওয়ার হিড়িক পড়েছে। সারা দেশে কংগ্রেসের সমান্তরাল ভিত্তি গড়ে তোলার যে চেষ্টা চলছে, তা মমতার রণকৌশল এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
দলীয় সূত্র ঘরোয়াভাবে জানাচ্ছে, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলকে সঙ্গে নিয়ে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে জোট তৈরি করতে চাইছেন মমতা। গতকাল রাতে মেঘালয়ের ঘটনার পর একথা আরও স্পষ্ট যে, এবার প্রকাশ্যেই বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের দুর্গে হানা দেবে তৃণমূল। আজ লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা অধীর চৌধুরী বলেন, ‘কংগ্রেসকে ভাঙার চক্রান্ত শুধু মেঘালয়ে নয়, পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে চালাচ্ছে তৃণমূল।’
গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক শিবিরে যে তর্ক সামনে এসেছে, তা হল— কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিজেপি-বিরোধী জোটের ধারণা আসলে সোনার পাথরবাটি কি না। দেশে ১২০টিরও বেশি আসনে লড়াই সরাসরি কংগ্রেস বনাম বিজেপির। কোনও স্থানীয় দলের পায়ের ছাপ সেভাবে সেখানে নেই। এমনও নয় যে, পোড়খাওয়া নেত্রী মমতা জাতীয় রাজনীতির এই বাস্তবতা জানেন না। আর তাই কংগ্রেস শিবিরের তোপ, আসলে কংগ্রেসকে বাইরে রেখে জোট গড়ার নামে বিজেপির হাতই শক্ত করছে তৃণমূল।
তৃণমূলের অবশ্য যুক্তি অন্য। সূত্রের বক্তব্য, বিভিন্ন রাজ্যে দলীয় সংগঠন বাড়িয়ে নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে নিজের বিজেপি বিরোধী মুখকে আরও ঝকঝকে করতে চাইছেন মমতা। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে বড় ব্যবধানে হারিয়েছেন তারা। একদিকে তাই রাজ্যে-রাজ্যে কংগ্রেস থেকে নেতা-কর্মীদের তৃণমূলে যোগ দেওয়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। অন্যদিকে, অকংগ্রেসি আঞ্চলিক দলের সঙ্গে কথাবার্তা চালানো শুরু করছেন মমতা। সম্ভবত ১ ডিসেম্বর এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ারের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে তার সূচনা।
এরপর উত্তরপ্রদেশেও যেতে পারেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূলের হিসাব, আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে মমতা নিজের নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করে রাজ্যে-রাজ্যে একটি পোক্ত বিজেপি-বিরোধী জোট বানাতে পারলে, লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেস বিরোধী জোটে নেতৃত্বের প্রশ্নে খবরদারি করতে পারবে না। বরং পরিস্থিতি তেমন দাঁড়ালে, বাইরে থেকে মমতাকেন্দ্রিক আঞ্চলিক জোটকে সমর্থন দিতে বাধ্য হবে তারা।
বুধবারই মমতা স্পষ্ট জানিয়েছেন, ‘আমরা সব রাজ্যে লড়ব না। যেখানে যে আঞ্চলিক দল শক্তিশালী, আমরা তাদের পাশে থেকে সমর্থন দেব।’ যে কারণে উত্তরপ্রদেশে তৃণমূলের ইউনিট খোলার কথা জানিয়েও তৃণমূল নেত্রীর বক্তব্য, এসপি নেতা অখিলেশ সিং যাদব যদি সাহায্য চান, তিনি সমর্থন করবেন। পাওয়ারের সঙ্গে বৈঠকটিকেও এই প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক শিবির।
রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, এক সময়ে প্রধানমন্ত্রিত্বের ‘স্বপ্ন দেখা’ পাওয়ারের রাষ্ট্রপতি হওয়ার অভিলাষ ক্ষমতার করিডরে গোপন বিষয় নয়। সে ক্ষেত্রে তাকে রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী হিসেবে সামনে রেখে জাতীয় রাজনীতিতে ঘুঁটি সাজাতে পারে তৃণমূল। মমতার উদ্যোগে যদি বিভিন্ন আঞ্চলিক বিরোধী দল এককাট্টা হয়ে পাওয়ারের নামে সম্মত হয়, তখন সোনিয়া-রাহুল তাতে আর কোনও বিরোধী বাদ সাধতে পারবেন না বলেই মনে করা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৮
আপনার মতামত জানানঃ