বিশ্বজুড়ে নতুন করে তাণ্ডব চালাচ্ছে করোনাভাইরাস। এরইমধ্যে সামনে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য। করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। এই ভ্যারিয়েন্টটি বহুবার রূপ বদল করতে পারে। ফলে এই ধরনের কারণে করোনাভাইরাস নতুন করে বিস্তার ঘটতে পারে বলে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশটির বিজ্ঞানীরা। খবর আল-জাজিরার।
গতকাল বৃহস্পতিবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা করোনার নতুন ধরন শনাক্ত হওয়ার খবর জানান। ইতিমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় কমপক্ষে ২২ জনের শরীরে নতুন এই ধরন শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কমিউনিকেবল ডিজিজেস (এনআইসিডি)। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বতসোয়ানা ও হংকংয়ে যাওয়া ভ্রমণকারীর শরীরেও করোনার নতুন এই ধরন পাওয়া গেছে।
প্রাথমিকভাবে এটির বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে বি.১.১.৫২৯। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনার ধরনগুলোকে গ্রিক নাম (যেমন ডেলটা, গামা, বেটা প্রভৃতি) দিয়ে থাকে। আজ সংস্থাটির পক্ষ থেকে নতুন এই ধরনের গ্রিক নাম দেওয়া হতে পারে।
দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জোয়ে ফাহলা বলেন, এটি খুবই উদ্বেগের একটি বিষয়। এমনিতেই দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনা সংক্রমণ নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। ভাইরাসটির নতুন ধরনের কারণে তা বিপদ আরও বাড়াতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
দক্ষিণ আফ্রিকার ভাইরোলজিস্ট তুলিও দে অলিভেইরা স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা করোনার নতুন একটি ধরন খুঁজে পেয়েছি। এটি দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য উদ্বেগজনক। এর ফলে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে পারে।
তিনি এই নতুন ধরনের ভয়াবহতা তুলে ধরে আরও জানান, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বতসোয়ানা ও হংকংয়ে যাওয়া মানুষদের মধ্যেও এটি শনাক্ত করা গেছে।
করোনার এই ধরনটি ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি মিউটেশন ঘটিয়েছে। এছাড়া নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট কতটা সংক্রামক ও প্রাণঘাতী হতে পারে, সে সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কাছে।
তবে নতুন প্রজাতির ভাইরাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা চিন্তিত। যুক্তরাজ্য বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, ভাইরাসের নতুন রূপ নিয়ে তারা রীতিমতো উদ্বিগ্ন। এছাড়া বিদ্যমান করোনা টিকা ভাইরাসের এই ধরনকে কতটা থামাতে পারবে সেটি নিয়েও উঠছে প্রশ্ন।
শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও ডয়চে ভেলে। ভারতীয় বার্তাসংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনার একটি নতুন ধরনের খোঁজ মিলেছে। যা আগে কখনও দেখা যায়নি।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এজেন্সি জানিয়েছে, এই নতুন প্রজাতির ভাইরাসের মধ্যে যে স্পাইক প্রোটিন আছে, তা অন্য করোনাভাইরাসের থেকে একেবারেই আলাদা। তাদের দাবি, আজ পর্যন্ত যত ধরনের করোনাভাইরাস এসেছে, এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ্যারিয়েন্ট। এই ভাইরাস কতটা ভয়ংকর, এটি রুখতে ভ্যাকসিন কাজ করবে কি না, কতটা দ্রুত তা ছড়ায় সবই গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখছেন।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ বলেছেন, প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে, এই ভ্যারিয়েন্ট আরও দ্রুত ছড়ায়। আর এখন যে ভ্যাকসিন চালু আছে, তা এর বিরুদ্ধে খুব বেশি কার্যকর হবে না।
যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানাসহ মোট ছয়টি দেশে যাতায়াতের ওপর কড়াকড়ি চালু করেছে। এছাড়া এসব দেশ থেকে যুক্তরাজ্যমুখী ফ্লাইট বন্ধ করা হয়েছে। অবশ্য যুক্তরাজ্যে এখনও ভাইরাসের এই ধরনে আক্রান্ত কেউ শনাক্ত হয়নি।
গতকাল বৃহস্পতিবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা করোনার নতুন ধরন শনাক্ত হওয়ার খবর জানান। ইতিমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় কমপক্ষে ২২ জনের শরীরে নতুন এই ধরন শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কমিউনিকেবল ডিজিজেস (এনআইসিডি)। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বতসোয়ানা ও হংকংয়ে যাওয়া ভ্রমণকারীর শরীরেও করোনার নতুন এই ধরন পাওয়া গেছে।
সাজিদ জাভিদ বলছেন, করোনাভাইরাসের নতুন ধরন নিয়ে বিজ্ঞানীরা ‘গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন’। তবে এ বিষয়ে আরও তথ্য প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, করোনার নতুন ধরনের সংক্রমণ রুখতে সতর্কতার অংশ হিসেবে এই ৬টি দেশকে রেড লিস্টে রাখা হয়েছে।
এছাড়া গত ১০ দিনে এই ছয়টি দেশ ভ্রমণকারী অ-ব্রিটিশ ও আয়ারল্যান্ডের বাসিন্দাদের শুক্রবার দুপুর থেকে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া গত ১০ দিনে আফ্রিকার এই ছয়টি দেশ ভ্রমণ করা ব্রিটেনের ও আয়ারল্যান্ডের বাসিন্দাদেরকে রোববার ভোর ৪টার পর থেকে যুক্তরাজ্যে প্রবেশের পর হোটেলে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে অবস্থানের নিয়ম করা হয়েছে।
এমনকি ইতোপূর্বে ভ্রমণ করে যুক্তরাজ্যে ফিরে আসা ব্যক্তিদেরও তাদের নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে থাকতে বলা হয়েছে।
এদিকে নতুন এই ধরনটি নিয়ে ভারতের সব রাজ্যকে সতর্ক করেছে দেশটির কেন্দ্র সরকার। বৃহস্পতিবার (২৫ নভেম্বর) এক চিঠিতে জানানো হয়েছে, যেসব যাত্রীরা ওই তিন দেশ থেকে আসবেন, তাদের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে। জোর দিতে হবে নজরদারি ও পরীক্ষায়। তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের বিষয়েও সতর্কতা বজায় রাখতে হবে।
বৃহস্পতিবার ভারতের সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মুখ্য সচিবদের লেখা চিঠিতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সচিব রাজেশ ভূষণ জানিয়েছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় নতুন ধরনের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ছয়জন। বতসোয়ানা ও হংকংয়ে আক্রান্তের সংখ্যা যথাক্রমে তিন ও এক। এ অবস্থায় ওই তিন দেশ থেকে যেসব যাত্রী আসবেন, তাদের ওপর কড়া নজরদারি চালাতে হবে। করতে হবে পরীক্ষা।
একইসঙ্গে গত ১১ নভেম্বর যে দেশগুলো থেকে ভারতে আগত যাত্রীদের ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রাখা হয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও একইরকমভাবে নজরদারি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির স্বাস্থ্য সচিব।
একজন বিশেষজ্ঞ করোনার বি.১.১.৫২৯ নামক এই ভ্যারিয়েন্টকে ‘এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এমনকি করোনার এই ধরন মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকেও আক্রমণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইউসিএল জেনেটিক্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক ফ্রাঙ্কোইস ব্যালক্সও ডব্লিউএইচওর অবস্থানকে অনুসরণ করে ব্লুমবার্গকে বলেন, ‘নতুন এই পরিবর্তিত ধরনটি কতখানি সংক্রামক হতে পারে, এ পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া পরিবর্তিত ধরনগুলোর তুলনায় এটি আরও ধ্বংসাত্মক হতে পারে কি না— এখনই এসব ব্যাপারে মন্তব্য করার সময় আসেনি।’
‘তবে একজন গবেষক হিসেবে আমি বলব, এখনই এই নিয়ে উদ্বেগে ভোগার কোনো কারণ নেই।’
দক্ষিণ আফ্রিকার সংক্রামক রোগ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কমিউনিকেবল ডিজিজেসের (এনআইসিডি) নির্বাহী পরিচালক অ্যাড্রিয়ান পুরেন এ সম্পর্কে বলেন, ‘এটা (নতুন ধরন শনাক্ত) খুব বেশি অবাক বা আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো সংবাদ নয়। যদিও এই মুহূর্তে আমাদের হাতে থাকা তথ্যের পরিমাণ একেবারেই কম, কিন্তু এনআইসিডি কাজ করছে। আশা করছি, দ্রুত এই ধরনটির বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।’
গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে অসংখ্যবার মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের দেহে সংক্রমিত হতে হতে বেশ কয়েক দফা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে সার্স কোভ-২ ভাইরাস বা নভেল করেনাভাইরাস। ফলে, বিশ্বে আবির্ভাব ঘটেছে এর অনেকগুলো বিবর্তিত ধরনের। সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে পরিবর্তিত এই ধরনসমূহের মধ্যে প্রধান বা প্রতিনিধিত্বশীল ধরনগুলোর বৈজ্ঞানিক নামের পাশাপাশি গ্রিক বর্ণমালা অনুসারে সেগুলোর নামকরণ করেছে ডব্লিউএইচও।
এর আগে এ রকম ছয়টি ধরনকে করোনাভাইরাসের প্রধান ও প্রতিনিধিত্বশীল ধরন হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ। এগুলো হলো— আলফা, বিটা, গ্যামা, ডেল্টা, কাপ্পা ও ল্যাম্বডা। এবার এই তালিকায় সপ্তম হিসেবে যুক্ত হলো মিউ, যার বৈজ্ঞানিক নাম বি.১.৬২১।
গত দেড় বছরে বিবর্তনের ফলে মূল করোনাভাইরাসের যে পরিবর্তিত ধরনসমূহের আবির্ভাব ঘটেছে সেগুলোকে দু’টি তালিকায় ভাগ করেছে ডব্লিউএইচও— পর্যবেক্ষণ তালিকা (ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট) এবং উদ্বেগজনক তালিকা (ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন)।
বর্তমানে ডব্লিউএইচওর উদ্বেগজনক ধরনের তালিকায় রয়েছে আলফা ও ডেল্টাসহ ভাইরাসের চারটি পরিবর্তিত ধরন। বিশ্বের ১৯৩ টি দেশে আলফায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে, আর ডেল্টায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে ১৭০ টি দেশে। অন্যদিকে, মিউসহ আরও ৫ টি পরিবর্তিত ধরনকে পর্যবেক্ষণ তালিকাভূক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩২
আপনার মতামত জানানঃ