করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারিতে সারা বিশ্ব যেভাবে থমকে দাঁড়িয়েছে, তাতে প্রকৃতি নিজের শুশ্রূষা কিছুটা হলেও করতে পেরেছে। বাধ্য হয়ে আরোপিত লকডাউনের কারণে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ আগের চেয়ে অনেক কমেছে, কমেছে বায়ুদূষণও। কিন্তু এত সবেও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কিন্তু থামানো যাচ্ছে না। সামগ্রিকভাবে লকডাউনের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের লাভ হলেও, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ওপর এর প্রভাব নগণ্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন তুঙ্গে। এখন পর্যন্ত রেকর্ড বইয়ের তথ্যে এ বছরের জুলাই মাসটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস। তাপমাত্রা যে হারে বাড়ছে তাতে ক্রমাগত বিপদ বাড়ছে মানব সভ্যতার।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য পুরুষরাই বেশি দায়ি। নারীর তুলনায় পুরুষ মাংসজাতীয় আমিষ খাবার ৪০ শতাংশ বেশি গ্রহণ করে। গবেষণা অনুসারে, নারীর চেয়ে পুরুষের এই বেশি আমিষযুক্ত খাবার জলবায়ু সংক্রান্ত উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বেশি দায়ি। যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান-এর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
যুক্তরাজ্যের নতুন এই গবেষণা নিবন্ধ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে পিএলওএস ওয়ান সাময়িকীতে। এতে ৩ হাজার ২০০ খাদ্যের সঙ্গে কার্বন নির্গমন সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের ২১২ জনের খাদ্যাভ্যাসের তথ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। গবেষণার সময় তারা তিন দিন ধরে খাবার ও পানীয় গ্রহণের তথ্য রেকর্ড করেন। সেখানে দেখা যায়, নিরামিষ খাদ্যাভ্যাসের তুলনায় আমিষ খাদ্যাভ্যাসের কারণে ৫৯ শতাংশ পর্যন্ত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বাড়ে। এর মধ্যে পুরুষের খাদ্যাভ্যাস গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে দায়ী ৪১ শতাংশ। কারণ, পুরুষ বেশি মাংস খান ও পানীয়তে অভ্যস্ত।
গবেষণায় দেখা গেছে, খাদ্য-সম্পর্কিত নির্গমনের এক-চতুর্থাংশই কফি, অ্যালকোহল, কেক এবং মিষ্টির মতো ঐচ্ছিক খাদ্য ও পানীয় থেকে আসে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, টেকসই খাদ্যকে উৎসাহিত করার নীতিগুলো উদ্ভিদভিত্তিক খাবারে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এতে পানীয় ও মিষ্টিজাতীয় খাবার থেকে সরে আসার আরও বেশি সুযোগ তৈরি হবে।
গবেষণার সময় গবেষকরা তিন দিন ধরে খাবার ও পানীয় গ্রহণের তথ্য রেকর্ড করেন। এতে দেখা যায় প্রাণিজ পণ্যগুলো গড় খাদ্যের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় অর্ধেকের জন্য দায়ী। এর মধ্যে মাংস ৩১ শতাংশ ও দুগ্ধজাত পণ্য ১৪ শতাংশ দায়ী। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য পানীয় ১৫ শতাংশ আর কেক, বিস্কুট ও মিষ্টান্ন দায়ী ৮ শতাংশ।
গবেষণায় দেখা যায়, নিরামিষ খাদ্যাভ্যাসের তুলনায় আমিষ খাদ্যাভ্যাসের কারণে ৫৯ শতাংশ পর্যন্ত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বাড়ে। এর মধ্যে পুরুষের খাদ্যাভ্যাস গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে দায়ী ৪১ শতাংশ। কারণ, পুরুষ বেশি মাংস খান ও পানীয়তে অভ্যস্ত।
যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হলি রিপিন এ গবেষণার নেতৃত্ব দেন। তিনি বলেন, ‘পৃথিবী রক্ষায় আমরা সবাই কিছু করতে চাই। এ জন্য খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন একটি উপায় হতে পারে। এ জন্য লাল মাংস খাওয়া বাদ দেওয়ার পাশাপাশি মিষ্টি খাওয়া বন্ধ করতে হবে।’
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য পুরুষরাই বেশি দায়ি। নারীর তুলনায় পুরুষ মাংসজাতীয় আমিষ খাবার ৪০ শতাংশ বেশি গ্রহণ করে। গবেষণা অনুসারে, নারীর চেয়ে পুরুষের এই বেশি আমিষযুক্ত খাবার জলবায়ু সংক্রান্ত উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বেশি দায়ি।
কোনও একটি জায়গায় বছরের পর বছর ধরে আবহাওয়ার যে গড়-পড়তা ধরন, তাকেই বলা হয় জলবায়ু। আবহাওয়ার সেই চেনাজানা ধরন বদলে যাওয়াকেই বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। পৃথিবী গরম হয়ে পড়ছে এবং তার ফলে দ্রুত বদলে যাচ্ছে আবহাওয়ার বহুদিনের চেনাজানা আচরণ। আর এই বদলে যাওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ হাতটিই মানুষের। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিসহ প্রকৃতির ওপর নানা অত্যাচারে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান ক্রীড়নক ভাবা হয় মানুষকে। বৈশ্বিক এই উষ্ণতা বিশ্বের ৮০ শতাংশ ভূ-অঞ্চলে প্রভাব ফেলেছে। এদিকে বিশ্বের অন্তত ৮৫ শতাংশ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তন দ্বারা সৃষ্ট আবহাওয়া বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছেন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ুর এই পরিবর্তনে বদলে যাবে আমাদের জীবন যাপন। পানির সঙ্কট তৈরি হবে। খাদ্য উৎপাদন কঠিন হয়ে পড়বে। কোনো কোনো অঞ্চল বিপজ্জনক মাত্রায় গরম হয়ে পড়বে এবং সেই সাথে সমুদ্রের পানি বেড়ে বহু এলাকা প্লাবিত হবে। ফলে সে সব জায়গা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
অতিরিক্ত গরমের পাশাপাশি ভারি বৃষ্টি এবং ঝড়ের প্রকোপ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকবে। ফলে জীবন এবং জীবিকা হুমকিতে পড়বে। গরীব দেশগুলোতে এসব বিপদ মোকাবেলার সক্ষমতা কম বলে তাদের ওপর এই চরম আবহাওয়ার ধাক্কা পড়বে সবচেয়ে বেশি।
তাপমাত্রা বাড়ায় উত্তর মেরুর জমাট বাধা বরফ এবং হিমবাহগুলো দ্রুত গলে যাচ্ছে। ফলে সাগরের উচ্চতা বেড়ে উপকূলের নিচু এলাকাগুলো ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।
এছাড়া সাইবেরিয়ার মত অঞ্চলে মাটিতে জমে থাকা বরফ গলতে থাকায় বরফের নিচে আটকে থাকা মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে, মিথেনের মত আরেকটি গ্রিনহাউজ গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। পৃথিবীর উষ্ণতা তাতে আরো বাড়বে এবং বন-জঙ্গলে আগুন লাগার ঝুঁকি বাড়বে।
কিন্তু জলবায়ুর এই পরিবর্তন এত দ্রুত হারে এখন ঘটছে যে অনেক প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যেমন, বরফ গলতে থাকায় পোলার বিয়ার বা উত্তর মেরুর শ্বেত ভালুকের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে।
পাশাপাশি, আটলান্টিক মহাসাগরের স্যামন মাছ বিপন্ন হবে, কারণ যেসব নদীতে ঢুকে তারা ডিম পেড়ে বাচ্চার জন্ম দেয়, সেগুলোর পানি গরম হয়ে যাচ্ছে।
ট্রপিক্যাল অঞ্চলের কোরাল রিফ বা প্রবাল-প্রাচীর উধাও হয়ে যেতে পারে, কারণ বায়ুমণ্ডলের অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড সাগরের পানিতে মিশে পানির অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
এর আগে এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া বর্তমান গতিতে চলতে থাকলে ২১ শতকের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে, খাদ্য ও পানির সংকটসহ ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে বিশ্ব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ফলে প্রাকৃতিক যে বিপর্যয় হবে তার রূপটা হবে ভয়াবহ৷ বিশ্ব এই অবস্থার মুখোমুখি হওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়৷ বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা যদি ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায় তবে ঝুঁকির পরিমাণও সেই অনুপাতে বাড়বে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব থেকে বিশ্বের কোনো মানুষই রেহাই পাবে না৷
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা সমাধানযোগ্য। আমাদের কাছে প্রযুক্তি আছে। বিজ্ঞান আছে। প্রয়োজন নেতৃত্ব এবং পথ পরিবর্তন করার সাহস। দূষণ রোধ করার জন্য শক্তির সুব্যবহার জরুরি। আমাদের ২০৫০ সালের মধ্যে বা শিগগিরই ‘নিট জিরো’ কার্বন নির্গমকে নিশ্চিত করতে হবে। নিট জিরো মানে— ক্রমান্বয়ে কার্বনের ভারসাম্যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনা। নিট শূন্য নির্গমন অর্জনের জন্য, আমরা যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি এবং ব্যবহার করি তার ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার।
আমাদের একটি নতুন, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা দরকার। বনভূমি উজাড় বন্ধ করা আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। উডল্যান্ড ট্রাস্ট আগামী ১০ বছরে ৬৪ মিলিয়ন গাছ লাগানোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তাকে অনুসরণ করাই হতে পারে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার একটি বিকল্প পথ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২২
আপনার মতামত জানানঃ