নতুন করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারিতে সারা বিশ্ব যেভাবে থমকে দাঁড়িয়েছে, তাতে প্রকৃতি নিজের শুশ্রূষা কিছুটা হলেও করতে পেরেছে। বাধ্য হয়ে আরোপিত লকডাউনের কারণে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ আগের চেয়ে অনেক কমেছে, কমেছে বায়ুদূষণও। কিন্তু এত সবেও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কিন্তু থামানো যাচ্ছে না। সামগ্রিকভাবে লকডাউনের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের লাভ হলেও, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ওপর এর প্রভাব নগণ্য।
আসন্ন দশকগুলোতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্টি হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ। বিশ্বব্যাপী লাখো শ্রমিকের জন্য তা একটি বড় ধরনের স্বাস্থ্য মহামারি হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন গবেষকেরা সম্প্রতি এ বিষয় নিয়ে সতর্ক করেছেন। এক প্রতিবেদনে এই খবর জানিয়েছে দ্য গার্ডিয়ান।
গবেষকরা বলছেন, তাপদাহের কারণে শরীরের ওপর সৃষ্ট প্রচণ্ড চাপে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বাড়ছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে শরীরে পানিশূন্যতা ও হিট স্ট্রেস দেখা দেয় এবং কিডনির ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। যা অচিরেই বিশ্বে কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার বড় কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
গবেষকেরা বলছেন, অধিক তাপমাত্রা ও ক্রনিক কিডনি ডিজিজ অব আনসার্টেইন কজের (সিকেডিইউ) মতো সম্পর্কের বিষয়টি জানতে আরও গবেষণা জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজন।
সাধারণত কিডনি রোগ (সিকেডি) বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ক্ষেত্রেও কিডনি রোগ দেখা যায়। তবে এল সালভাদর বা নিকারাগুয়ার অধিক উষ্ণ অঞ্চলে ইতিমধ্যে সিকেডিইউ মহামারি দেখা দিয়েছে। সেখানে অনেক কৃষকের কিডনি বিকল হয়ে মৃত্যুর হার অস্বাভাবিকভাবে বেশি।
দ্য গার্ডিয়ান–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তর ও মধ্য আরেমিকার কিছু কিছু অঞ্চলে উচ্চ তাপমাত্রায় ভারী কাজ করেন, এমন শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সিকেডিইউ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার রেকর্ড আকারে বাড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ভারতেও সিকেডিইউ আক্রান্ত রোগী বাড়ছে।
কিডনি দেহের তরল ভারসাম্যের জন্য দায়ী, যা বিশেষ করে চরম তাপমাত্রার প্রতি সংবেদনশীল করে তোলে। কিডনি সমস্যার বিষয়টি অধিক তাপসংশ্লিষ্ট আঘাত হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি নিয়ে অনেকেই এখন একমত পোষণ করছেন।
কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির জলবায়ু ও স্বাস্থ্যশিক্ষার বৈশ্বিক কনসোর্টিয়ামের পরিচালক সিসিলিয়া সোরেনসেন বলেন, কিডনিতে এ ধরনের আঘাতের বিষয়টি সাধারণত কোনো উপসর্গ দেখায় না। অনেক শ্রমিক শেষ ধাপে যাওয়ার আগপর্যন্ত অসুস্থ হওয়ার বিষয়টি বুঝতেও পারেন না।
সোরেনসেন আরও বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে নজরদারি করি না বলে এর সমস্যাটির ব্যাপ্তি কী, সে সম্পর্কে আমাদের ঠিক ধারণা নেই। এমন কিছু অঞ্চল রয়েছে, যা স্পষ্টভাবে হটস্পট কিন্তু এর বিস্তারের বিষয়টি কতটা গুরুতর সমস্যা, তা নিয়ে আমরা ভাবছি না।’
করোনার কারণে গত বছর জলবায়ু কিছুটা স্বস্তিতে ছিল। কার্বনসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমে যাওয়ায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার শঙ্কা ছিল না বললেই চলে। রাস্তায় গাড়ি কম, কারখানায় নেই উৎপাদন আর মানুষের ভোগ্যপণ্যের জোগানও তেমন বেশি দেখা যায়নি।
কিন্তু চলতি বছর সেই চিত্রটা পাল্টে গেছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে উঠেপড়ে লেগেছে বিশ্বের ধনী দেশগুলো। রাস্তায় বেড়েছে গাড়ি আর মানুষ, কারখানায় উৎপাদন এখন আগের চেয়ে কয়েকগুণ। এরই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণেও।
‘দ্য ক্লাইমেট ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্ট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের ২০টি ধনী দেশে কার্বন নিঃসরণের হার বেড়েই চলেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধনী ও উন্নত দেশগুলোর জোট জি-২০-এর সদস্য দেশগুলোতে এ বছর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন ৪ শতাংশ বাড়বে। গত বছর করোনা মহামারির কারণে এসব দেশে কার্বন নিঃসরণের হার ৬ শতাংশ কমেছিল। এ বছর চীন, ভারত এবং আর্জেন্টিনাও তাদের ২০১৯ সালের কার্বন নির্গমন মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে।
প্রতিবেদনে জি-টোয়েন্টি দেশগুলোতে কয়লার ব্যবহার এ বছর পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য দায়ী থাকবে চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতেও কয়লার ব্যবহার বাড়ছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে জোরেশোরে এগোতে থাকায় চীনে জ্বালানি চাহিদা বেড়েছে। তাই সেখানে কয়লার ব্যবহারও বাড়তে দেখা গেছে। সঙ্গে বেড়েছে দামও। গত বছরের তুলনায় কয়লার দাম ২০০ শতাংশ বেড়েছে।
ক্লাইমেট ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জি-টোয়েন্টি দেশগুলোতে গ্যাসের ব্যবহার ১২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
রাজনৈতিক নেতারা কোভিডের ধাক্কা থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সবুজের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ধনী দেশগুলো বাস্তবে সে পথে হাঁটেনি। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যে ১৮০ কোটি ডলার খরচের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে মাত্র ৩০ কোটি ডলার সবুজ প্রকল্পের জন্য রাখা হয়েছে।
প্রতিবেদনে ধনী দেশগুলোতে সৌর এবং বায়ুশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির বিষয়টিও উঠে এসেছে। গত বছর জি-টোয়েন্টি দেশগুলোতে রেকর্ড পরিমাণ সৌর প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। ২০২০ সালে যেখানে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ছিল ১০ শতাংশ, তা এ বছর ১২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
উত্তর ও মধ্য আরেমিকার কিছু কিছু অঞ্চলে উচ্চ তাপমাত্রায় ভারী কাজ করেন, এমন শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সিকেডিইউ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার রেকর্ড আকারে বাড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ভারতেও সিকেডিইউ আক্রান্ত রোগী বাড়ছে।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠেয় জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন কপ-২৬ এর দুই সপ্তাহ বাকি। সম্মেলনের অন্যতম লক্ষ্য হলো, তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টিকে নাগালের মধ্যে রাখার পদক্ষেপ নেওয়া।
প্রাক-শিল্পযুগের তুলনায় বর্তমানে বিশ্ব এক দশমিক এক ডিগ্রি বেশি উষ্ণ। ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা বৃদ্ধিকে সীমাবদ্ধ রাখাটা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। নতুন গবেষণা প্রতিবেদনে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ধনী দেশগুলোর দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার তথ্য উঠে আসেনি।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শিল্প বিপ্লব শুরুর আগে বিশ্বের যে তাপমাত্রা ছিল তার থেকে বৃদ্ধির মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা গেলে বড় ধরনের বিপদ এড়ানো যাবে। তা না পারলে বিপজ্জনক হয়ে পড়বে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবীর আবহাওয়া পাল্টে যাবার কথা অনেকদিন থেকেই আলোচনায়। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছিলেন। ওজোনস্তর ফুটো হয়ে যাবার কথাও অনেক পুরোনো। কিন্তু সেই পুরোনো কথার গুরুত্ব কেউ দেয়নি। আর দিলেও তা যে যথাযথভাবে দেওয়া হয়েছে, এমন বলার সুযোগ নেই।
বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা মানুষ শুনেছে। রাষ্ট্রপ্রধানরা তহবিল সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ফোরামের নানা আয়োজনে উত্তেজক কথাবার্তা বলে হাততালি নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। একে অন্যকে দোষারোপের সংস্কৃতিও রয়েছে। আর ধনী রাষ্ট্রগুলো যেভাবে কার্বন নিঃসরণ করছে, তার বিপরীতে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো রীতিমতো অসহায়। ফলে একদিকে দোষারোপের সংস্কৃতি, দরিদ্র দেশগুলোর আহাজারি, পৃথিবীব্যাপী সচেতন মানুষদের আর্তনাদ অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলে অবিচ্ছিন্নভাবে কার্বন নিঃসরণ চলতে থাকে। ফলে বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তাও ফলতে শুরু করেছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, হিমালয়ের বরফ গলছে। সেই পানি ধেয়ে আসছে সমুদ্রে। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। আর ওজোনস্তরের ফুটো বাড়তে থাকারও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
বিশ্বের তাপমাত্রার যে পরিবর্তন তাও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। পেছনের একশ বছরের তাপমাত্রা মিলিয়ে দেখে, বায়ুমণ্ডল এবং পৃথিবীপৃষ্ঠ উষ্ণ হয়ে ওঠার প্রমাণও হাতেনাতে ফলতে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবেলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়ানোর পথ একটাই, সেটা হল শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোকে এক টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৩
আপনার মতামত জানানঃ