করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় যথাযথ বিবেচনা ছাড়াই হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেওয়ার কথা উঠে এসেছে কয়েকটি সমীক্ষায়। এর সঙ্গে যুক্ত গবেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে এই জীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলো ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলতে পারে।
গবেষকরা বলেছেন, ব্যয়বহুল অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার রোগীদের ওপর অনাবশ্যক আর্থিক চাপে ফেলছে।
অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে অপ্রতিরোধ্য ব্যাকটেরিয়া বা ‘সুপারবাগ’-এর প্রাদুর্ভাব বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। সুপারবাগের বিরুদ্ধে প্রচলিত ওষুধগুলো কাজ করে না। মহামারি এই ঝুঁকি আরও বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। ফলে আজ যেসব অসুখ আমরা সাধারণ বলে মনে করি, ভবিষ্যতে সেগুলোও মানুষের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
করোনাভাইরাস মহামারির সময় অ্যান্টিবায়োটিক এবং অন্যান্য অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে অ্যান্টিবায়োটিক র্যাজিস্টেন্স বাড়ছে। ফলে সময়ের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ও জীবনরক্ষাকারী এই ওষুধগুলো অকার্যকর হয়ে পড়বে বলে সতর্ক করেছে প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশন (পিএএইচও)।
বুধবার আমেরিকান সংস্থাটি জানায়, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, ইকুয়েডর, গোয়াতেমালা এবং প্যারাগুয়েসহ বিভিন্ন দেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে। অর্থাৎ, বিদ্যমান অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধগুলো আর কাজ করছে না। ফলে হাসপাতালে ভর্তি থাকা কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুহারও বাড়ছে বলে ধারণা করছেন তারা।
সুপারবাগ হচ্ছে এক ধরনে অণুজীব। যেসব ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হলে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর, তাদের সুপারবাগ বলা হয়। এরা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে বলে এদের মাল্টি ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট বলা হয়। অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্ট একটি বৈশ্বিক সমস্যা।
পেনিসিলিন আবিষ্কারের মাধ্যমে ১৯২৮ সালে পৃথিবীতে অ্যান্টিবায়োটিকের যাত্রা শুরু হয় এবং সে সময় থেকে নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট। অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ও অপর্যাপ্ত ব্যবহার (ওষুধের মাত্রা ও সময়কাল), কৃষি ও গবাদিপশুতে অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ইত্যাদিই পৃথিবীজুড়ে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট বাড়ার জন্য মূলত দায়ী। বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকা রেজিস্ট্যান্ট জিনগুলো প্রাণিদেহে আদান-প্রদান করে এবং খুব সহজে ও অল্প সময়েই তারা বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সক্ষমতা লাভ করে। গ্রাম-পজিটিভ ও গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে যারা এই সক্ষমতা অর্জন করে, তাদের ‘সুপারবাগ বা মাল্টিড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া’ বলা হয়।
অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে অপ্রতিরোধ্য ব্যাকটেরিয়া বা ‘সুপারবাগ’-এর প্রাদুর্ভাব বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। সুপারবাগের বিরুদ্ধে প্রচলিত ওষুধগুলো কাজ করে না। মহামারি এই ঝুঁকি আরও বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। ফলে আজ যেসব অসুখ আমরা সাধারণ বলে মনে করি, ভবিষ্যতে সেগুলোও মানুষের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সক্ষমতাসম্পন্ন এসব ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট সংক্রমণ নিরাময়ের জন্য পৃথিবীব্যাপী কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যা নিতান্তই কম। এসব সংক্রমণে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেশি। একই সঙ্গে এসব সংক্রমণ হাসপাতালে রোগীর অবস্থানকে দীর্ঘায়িত করে এবং রোগীর চিকিৎসার ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট বিশ্ব স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি। মানুষ ও প্রাণিদেহে অবিবেচকের মতো অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারই এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে অজ্ঞতা, রোগী ও রোগীর চিকিৎসা সরঞ্জাম ময়লা হাতে ধরা এবং অপ্রয়োজনে বা ভাইরাল ইনফেকশনে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের প্রবণতা বিশ্বজুড়ে এই ভয়াবহতার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ।
২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এই সঙ্কটজনক হুমকিটি (সুপারবাগ) এখন আর কোনও ভবিষ্যদ্বাণী নয়। এটি এখন বিশ্বের প্রত্যেক স্থানেই ঘটছে। এছাড়া বিশ্বের যে কোন দেশের যে কোন বয়সের যে কোন ব্যক্তিকে আক্রমণ করার ক্ষমতা রয়েছে।
প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী সাত লাখ মানুষ মারা যায় এই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে। ধারণা করা হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে এটি প্রায় ১ কোটিতে পৌঁছে যাবে।
পিএএইচওর পরিচালক কারিসা ইতিয়েনে বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা ব্যাপকহারে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের ব্যবহার দেখেছি। এর সম্ভাব্য পরিণাম গুরুতর। সাধারণ সংক্রমণের ক্ষেত্রে আমরা যেসব ওষুধের ওপর নির্ভর করি, সেগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে আছি আমরা’।
ব্রাজিলের মতো অনেক দেশেই কোভিড চিকিৎসায় আইভারম্যাক্টিন ও ক্লোরোকুইন ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়েছিল।
এই অঞ্চলের হাসপাতালগুলো থেকে সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, হাসপাতালে ভর্তি থাকা কোভিড আক্রান্ত রোগীদের ৯০ থেকে ১০০ শতাংশের চিকিৎসায় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ৭ শতাংশের অন্যান্য সংক্রমণও দেখা দেয়। অথচ এই সংক্রমণগুলো একই ওষুধ প্রয়োগে সেরে যাওয়ার কথা ছিল বলে জানান তিনি।
কারিসা ইতিয়েনে বলেন, ‘মহামারির সময় আমরা ইচ্ছেমতো অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ব্যবহার করেছি। এর প্রতিক্রিয়া সম্ভবত আরও মাসখানেক কিংবা বছরখানেক পর ভালোমতো বোঝা যাবে’।
তবে কোভিড মোকাবেলায় বিশ্বের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যেভাবে ন্যূনতম সময়ে ভ্যাকসিন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে, একইভাবে নতুন ও সাশ্রয়ী অ্যান্টোবায়োটিকের বিকাশে সম্মিলিত উদ্যোগের প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থাও ব্যতিক্রম কিছু নয়। প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ, সাধারণ ভাইরাসজনিত সর্দিজ্বরে ইচ্ছেমতো অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়া, ফার্মেসিগুলোতে প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয়, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসকদের নিয়ম না মেনে ইচ্ছামতো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, হাঁস-মুরগি, পশু ও কৃষিতে ব্যাপক হারে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে অজ্ঞতা/অসচেতনতাই এই সমস্যার মূল কারণ।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, সম্প্রতি অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহার এবং অপব্যবহারের কারণে ব্যাকটেরিয়ার কিছু স্ট্রেইন তাদের ডিএনএতে সামান্য পরিবর্তন এনে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ‘সুপারবাগে’ রূপান্তরিত হয়েছে।
তারা জানান, প্রয়োজন না থাকার পরও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের কারণে মূলত এমনটা ঘটে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে এর ভয়াবহতা পরিলক্ষিত না হলেও ভবিষ্যতে এটি সর্বোচ্চ ট্র্যাজেডি হতে যাচ্ছে, এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যায়। ২০০১ সালের দিকে এইচআইভি ভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে দেশব্যাপী অনেক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছিল, যার দরুন বাংলাদেশে এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক কম। ব্যাপক ঘনবসতি হওয়ার কারণে বাংলাদেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্ট আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। এইচআইভির মতো এটি এত ভয়াবহ না হলেও অদূর ভবিষ্যতে এটি অনেক ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে।
দিন দিন সহজলভ্য অ্যান্টিবায়োটিকের এমন অকার্যকর হয়ে পড়াও চিকিৎসাপদ্ধতিকে কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল করে তুলছে। এর ফলে ক্রমবর্ধমান এই সমস্যার দিকে দৃষ্টি দেওয়া এখন সময়ের দাবি। চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট ও নার্সদের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে এবং একই লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে জনগণকেও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণে সচেতন করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪০
আপনার মতামত জানানঃ