নগর সভ্যতার ডামাডোলে গোটা বিশ্ব এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যেখানে প্রাণ ধারণের জন্য ন্যূনতম বিশুদ্ধ আলো, বাতাস ও পানির মতো প্রকৃতির অফুরান দানগুলো অবশিষ্ট থাকার সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে নানা বিরূপ প্রভাবসহ মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে ক্রমেই হুমকির মুখে এগিয়ে চলছে জনজীবন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দ্রুত শিল্পায়নের এই অশুভ প্রতিযোগিতার করাল গ্রাসে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে দূষণ।
পরিবেশে সূক্ষ্ম কণার উপস্থিতি বায়ুদূষণের মাত্রা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। ইউরোপজুড়ে এই সূক্ষ্ম কণা জনিত বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যুর হার বার্ষিক ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যদিও অদৃশ্য এই ঘাতক এখনো বছরে ইউরোপের তিন লাখ সাত হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। সোমবার (১৫ নভেম্বর) ইউরোপীয় পরিবেশ সংস্থা প্রতিবেদনের মাধ্যমে তথ্যটি জানিয়েছে।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপিয়ানভুক্ত দেশগুলো যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ বায়ু মানের নির্দেশিকাগুলো অনুসরণ করে তাহলে ২০১৯ সালে যে সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার অর্ধেকে নেমে আসবে। ২০১৮ সালে ইউরোপে বায়ুদূষণজনিত কারণে তিন লাখ ৪৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বায়ুদূষণ ডেটা সেন্টার জানিয়েছে, অনুকূল আবহাওয়ার জন্য পরের বছর অর্থাৎ সম্প্রতি মৃত্যুর হার কমে আসছে।
এতে বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বায়ুদূষণের গ্রহণযোগ্যমাত্রা সম্পর্কিত যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিল তা মেনে চলার ব্যাপারে যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো সবাই একমত হতো, তাহলে এই মৃত্যুর শতকরা ৫৮ ভাগ এড়ানো যেত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিক নির্দেশনা অনুযায়ী— প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে সর্বোচ্চ ৫ মাইক্রোগ্রাম দূষণ থাকতে পারে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জার্মানিতে বায়ু দূষণে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। এক বছরের সেখানে বায়ু দূষণের ফলে অকালে মৃত্যুবরণ করেছে ৫৩ হাজার ৮০০ মানুষ। এর পরেই রয়েছে ফ্রান্স। দেশটিতে বায়ু দূষণের ফলে অকালে ৪৯ হাজার ৯০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
বায়ু দূষণে মৃত্যু হারের দিক দিয়ে ইতালি তৃতীয় এবং স্পেন চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। ইতালিতে এক বছরে মারা গেছে ২৯ হাজার ৮০০ এবং স্পেনে মারা গেছে ৩০ হাজার ৩০০ মানুষ। তবে জনসংখ্যার মাথাপিছু হারে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে পোল্যান্ডে। সেখানে বায়ুদূষণে এক বছরে মারা গেছে ৩৯ হাজার ৩০০।
পরিবেশে সূক্ষ্ম কণার উপস্থিতি বায়ুদূষণের মাত্রা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। ইউরোপজুড়ে এই সূক্ষ্ম কণা জনিত বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যুর হার বার্ষিক ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যদিও অদৃশ্য এই ঘাতক এখনো বছরে ইউরোপের তিন লাখ সাত হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।
১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে বায়ুতে থাকা সূক্ষ্ম কণার ফলে ইউরোপের ২৭টি দেশের প্রায় ১০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হয়। এ সূক্ষ্ম কণা মানুষের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত করে। সূক্ষ্ম কণাজনিত কারণ ছাড়াও অন্য দুইটি দূষণের ফলে মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছে বলেও জানায় ইউরোপীয় পরিবেশ সংস্থা।
গাড়ি, ট্রাক, থার্মাল পাওয়ার স্টেশন থেকে নিঃসরিত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের কারণেও ব্যাপক মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড করা হয়। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এর কারণে ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ওজন স্তরের দূষণের ফলে মৃত্যুর সংখ্যা ২০১৯ সালে ১৩ শতাংশে নেমেছে।
মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বায়ুদূষণ একটি বড় ক্ষতির কারণ বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। হৃদরোগ ও স্ট্রোকের কারণে বেশিরভাগ মানুষের অকাল মৃত্যু হয়। আর এর জন্য মূলত বায়ুদূষণ দায়ী বিশেষ করে ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ শিশুদের ফুসফুস বিকাশের ক্ষেত্রে ক্ষতি করে। তাছাড়া তাদের শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ও হাঁপানি রোগ বাড়াতে পারে। বয়ুদূষণের ফলে বয়স্করা বেশি ঝুঁকিতে আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বায়ুদূষণ বিশ্বে বছরে ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটায়। ধূমপান ও খারাপ খাদ্যের মতো একই মাত্রায় ক্ষতি করে বায়ুদূষণ।
বায়ুদূষণ সব দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তবে এটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, প্রতিবছর শুধু বায়ুদূষণে বিশ্বে ৭০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু হয়। এ সমস্যার সমাধানে বিশ্বজুড়ে বায়ুর মান উন্নত করতে এয়ার কোয়ালিটি গাইডলাইনস (একিউজিএস) আরও জোরদার করেছে সংস্থাটি।
ডব্লিউএইচও’র মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে তৈরি হচ্ছে মারত্মক বায়ুদূষণ। এর ফলে ফুসফুস হৃদযন্ত্র ও শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বস্তুকণা, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য দূষণ তৈরিকারী উপাদানের উপস্থিতি কমাতে হবে। সেকারণেই বায়ুর মান নিয়ে এই নতুন নির্দেশনা।
প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা কমে শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রথমে শ্বাসনালি ও চোখে সমস্যা তৈরি করে। ফলে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ দূষিত বায়ু গ্রহণ ব্রঙ্কাইটিস থেকে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এদিকে বায়ুদূষণের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বেশি দেখা দেয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, শিল্প কলকারখানাগুলি যাতে আর্থিক চাপের মুখে না পড়ে তাই পরিবেশ রক্ষা সংক্রান্ত আইনকানুনকে উপেক্ষা করা হয়৷ বেশির ভাগ কলকারখানাই ইউরোপীয় মানসম্মত নয়৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাতাসের গুণগত মান রক্ষা করার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে৷ যেমন বলা হয়েছে, কলকারখানাগুলিতে সূক্ষ্ম ধুলিকণা প্রতিরোধী ফিল্টার লাগাতে হবে৷ তাপ উৎপাদন কেন্দ্রগুলিতে কয়লার পরিবর্তে গ্যাসের ব্যবহার করতে হবে৷ গাড়িতে ক্যাটালিটিক কনভার্টার ব্যবহার করতে হবে৷
এক্ষেত্রে আর্থিক সুযোগ সুবিধা মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে৷ যেমন পরিবেশ দূষণের জন্য বিশেষ করের প্রবর্তন করা যেতে পারে৷ যারা বায়ু দূষণকারী মেশিন ও কারিগরি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন, তাদের ওপর এই কর আরোপ করা হলে বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে দায়িত্ববোধ জেগে উঠতে পারে৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪০
আপনার মতামত জানানঃ