চীনের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন নির্যাতিতরা। দুই সন্তান নিয়ে চীনের উইঘুর অধ্যুষিত জিনজিয়াং প্রদেশ থেকে তুরস্কে পালিয়ে আসা গুলজারা মুহাম্মদ সম্প্রতি আরব নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন।
গুলজারার জন্ম ধর্মপ্রাণ একটি মুসলিম পরিবারে। তার বাবা স্থানীয় উইঘুর শিশুদের কুরআন শিক্ষা দিতেন এবং তার স্বামী একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। সবই চলছিল সুন্দরভাবে কিন্তু ইসলামভীতির কারণে বহুদিন ধরে গুলজারার পরিবারের ওপর গোপনে নজরদারি করে আসছিল চীনের গোয়েন্দারা।
এরপর ২০১৮ সালে হঠাৎ একদিন চীনের সরকারি বাহিনী তার স্বামী ও বাবাকে বাসা থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় বাধা দিতে গেলে তাকেও তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। সমাজে ধর্মবিদ্বেষ ও অস্থিরতা সৃষ্টির অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের ঘরে থাকা সব কুরআন শরিফও জব্দ করে নিয়ে যায় পুলিশ।
এ সময় পুলিশকে গুলজারা বলেছিলেন, আমার স্বামী এবং বাবা তো কোনো দেশদ্রোহী কাজ করছে না। তাহলে তাদের কেন এভাবে হাতকড়া লাগিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে- জানতে চেয়েছিলেন গুলজারা। তখন তার ওপর থুতু নিক্ষেপ করে পুলিশ হুমকি দেয়, বেশি কথা বললে তোকেও তুলে নিয়ে যাব।
তিনি বলেন, এ সময় তাদের ছেড়ে দিতে অনেক কান্নাকাটি করলেও পুলিশ ছাড়েনি। তারা আমাদের সঙ্গে পশুর চেয়েও জঘন্য আচরণ করেছে।
এরপর পরিচিত এক শিক্ষকের মাধ্যমে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে তার বাবা এবং স্বামীকে ছাড়িয়ে আনলেও থানা থেকে বের হওয়ার একদিন পরই তার বৃদ্ধ বাবা প্রচণ্ড মনোকষ্ট নিয়ে মারা যান। পরে স্বামী-সন্তান নিয়ে তুরস্কে পালিয়ে আসেন গুলজারা। কিন্তু তাদের মতো সৌভাগ্য সবার কপালে জুটে না।
সূত্র মতে, উইঘুর নারীদের প্রতি তিন মাস পর পর পরিবার-পরিকল্পনা কর্মীরা এসে পরীক্ষা করেন, তারা গর্ভধারণ করেছেন কিনা। অনেক উইঘুর নারীকে বন্দিশিবিরে আটক রেখে ধর্ষণ করা হচ্ছে নিয়মিতভাবে। একসময় তাদের বন্ধ্যা করে দেওয়া হচ্ছে, যাতে বন্দিশিবিরে তাদের ওপর চালানো পাশবিক নির্যাতনের কোনো প্রমাণ না থাকে।
এমনকি জোর করে তাদের শূকরের মাংস খাওয়াচ্ছে তাদের ধর্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেবে। ধর্ষণের পর এসব উইঘুর নারীকে চীনা যুবকদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বেশ আগে থেকেই সরকারি নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে বেশি সংখ্যায় সন্তান জন্ম দেওয়ায় উইঘুর ও অন্যান্য সংখ্যালঘু নারীদের ক্যাম্পে বন্দি করে রাখার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া ২০১৯ সালে বিবিসির করা এক তদন্তে উঠে আসে যে, জিনজিয়াংয়ের মুসলিম শিশুদের তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে যেন তারা মুসলিম সম্প্রদায়ের থেকে আলাদা হয়ে বড় হয়।
চীনা গবেষক আদ্রিয়ান জেনজের লেখা এক প্রতিবেদন অনুসারে, যে সব নারী দুটির চেয়ে কম সন্তান জন্ম দিতে আইনিভাবে বৈধ, তাদের জরায়ুতে আইইউডি (ইন্ট্রা-ইউটেরিন ডিভাইস যেটি সাধারণত ৫ থেকে ১০ বছরের জন্য নারীদের গর্ভধারণ করা থেকে বিরত রাখে) প্রবেশ করানো হচ্ছে।
আর অন্যদের বন্ধ্যা করানোর উদ্দেশ্যে জোর করে সার্জারি করানো হচ্ছে। জিনজিয়াংয়ের বন্দি শিবিরে থাকা সাবেক সদস্যদের বক্তব্যে উঠে এসেছে যে সেখানে থাকা নারীদের গর্ভ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে তাদের মাসিক বন্ধ করতে বিভিন্ন রকম ওষুধও প্রয়োগ করা হতো তাদের ওপর।
সামগ্রিকভাবে দেখলে মনে হয়, তিন বা তার চেয়ে বেশি সংখ্যক সন্তান আছে যেসব নারীর, তাদের ঢালাওভাবে বন্ধ্যা করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এভাবে উইঘুরদের তিলে তিলে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে চীনা সরকার।
চীনের ইসলাম ভীতি
প্রায় ১৪০০ বছর ধরে চীনা সমাজে ইসলাম ধর্ম পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে মুসলিমরা চীনের একটি অন্যতম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। চীনের মোট জনসংখ্যার ১ থেকে ৩% ইসলাম ধর্মাবলম্বী।
তবে ইসলামকে নিয়ে চীনের ভীতি এখন সর্বজনস্বীকৃত। ২০১৯ সালে ইসলামকে চীনের সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে নতুন আইন করার সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির প্রশাসন।
চীনের ধর্মীয় আচারে এই পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে তাদের অতি জাতীয়তাবাদের লক্ষণ বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷ চীনারা মনে করে, আরব সংস্কৃতি মানেই ভয়ানক কিছু৷ তাই চীনা মুসলমানদের জীবন থেকে তাবৎ আরব আচার মুছে ফেলাটাই সঠিক সিদ্ধান্ত৷ এটিকে চীনা জাতীয়তাবাদের চরম পর্যায় বলা যায়, যার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় বিশ্বাসকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় চীন৷
দেশটির ১০ লাখেরও বেশি মুসলিমকে বিভিন্ন অস্থায়ী ক্যাম্পে আটক রেখে ধর্ম পালনে বাধা এবং জোর করে কমিউনিস্ট মতাদর্শে আস্থাশীল করার চেষ্টা হচ্ছে বলেও ধারণা জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার৷
এমনকি চীনের বিভিন্ন মসজিদ থেকে গম্বুজ ও চাঁদ-তারার প্রতিকৃতি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে৷ সেখানে মাদ্রাসার পাশাপাশি আরবি ভাষা শেখানোও নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন কখনোই অধিক বিদেশি বৈশিষ্ট্য সম্বলিত ধর্ম প্রসার হতে দেবে না৷ এক কথায় বলতে গেলে ইসলাম ধর্মের হাত ধরে যে আরব সংস্কৃতির প্রসার ও আরব ঘরানার মসজিদ গড়ে উঠছে চীনে, সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করাই চীনা প্রশাসনের মূল লক্ষ্য৷ এর মধ্য দিয়ে ধর্মীয় বিশ্বাসকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় চীন৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৫৬
আপনার মতামত জানানঃ