দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বগতির দিকে। এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় জনজীবনে দেখা দিয়েছে নানা শঙ্কা। দাম বাড়ার একদিনের মাথায় প্রভাব পড়েছে পরিবহন খাতে। গণপরিবহনে আদায় হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। এ নিয়ে যাত্রী ও বাস স্টাফদের মধ্যে ঘটছে বাকবিতণ্ডা। ঘোষণার আগে গণপরিবহনে বাড়তি ভাড়া নিয়ে ক্ষুব্ধ যাত্রীরা। এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ক্ষুব্ধ পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টরাও।
ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য প্রতি লিটার ১৫ টাকা বৃদ্ধির প্রতিবাদে আজ থেকে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি। শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য গণপরিবহন ও পণ্যবাহী যানবাহন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংগঠনটি।
গতকাল এক জরুরি সভা শেষে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠনটি। এদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বাস ভাড়া বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয়ে গতকাল একটি চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। বিপরীতে গতকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত বুধবার দেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এর আগে ২ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু ও মুক্তারপুর সেতুর টোলহার বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। জ্বালানি তেল ও টোল বৃদ্ধির প্রতিবাদে আজ থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা।
গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২ নভেম্বর হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তারপুর সেতুর টোল ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। একদিন যেতে না যেতেই জ্বালানি তেলের দাম একলাফে বেড়েছে লিটারে ১৫ টাকা। করোনা মহামারির প্রভাব কাটিয়ে সাধারণ পরিবহন মালিকরা যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, তখন এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধি পরিবহন মালিকদের ব্যবসায় বাধা সৃষ্টি করছে। এ মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আজ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পণ্য পরিবহন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা ধর্মঘট কর্মসূচি গ্রহণ করলেও কেন্দ্রীয়ভাবে যাত্রীবাহী বাস চলাচলে এ ধরনের কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি বলেন, আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে বাস ধর্মঘটের কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করিনি। জেলা পর্যায় থেকে যদি এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসে, তাহলে সেখানে আমাদের করার কিছুই নেই। কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা না দিয়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করায় পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে এ সময় জানান তিনি।
এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর পরিবহন খাতের বিভিন্ন সংগঠনের মালিক-শ্রমিকরা গতকাল বৈঠক করেছেন। অনেকেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বাস ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। অধিকাংশ সংগঠনের নেতারা সরকারপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেও সরকার ভাড়া বৃদ্ধি না করা পর্যন্ত পরিবহন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে একটি অংশ বলছেন, ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে সংগঠনের নেতাকর্মীরা বৈঠক করবেন। বিআরটিএ ভাড়া সমন্বয়ে রাজি হলে রাজধানীসহ সারা দেশে গণপরিবহন আগের মতোই চলবে। অন্যথায় গণপরিবহনের সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে।
পরিবহন সূত্রগুলো বলছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর পরিবহন খাতের বিভিন্ন সংগঠন নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে। এসব বৈঠক থেকে ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার আগপর্যন্ত পরিবহন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঢাকায়ও বাস চলবে না বলে মালিকেরা বলছেন।
বাসমালিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ডিজেলের দাম বাড়ানোয় বাস চালিয়ে লোকসান গুনতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন জেলার পরিবহনমালিকেরা বাস না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পণ্যবাহী যানবাহন মালিকদের সংগঠন ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্যাংকলরি, প্রাইম মুভার মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান বলেন, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পণ্য পরিবহনে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার জ্বালানি তেল খরচ হয়। ডিজেলের দাম বাড়ায় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকার জ্বালানি খরচ বেড়ে যাবে।
পরিবহন খাতের সূত্র বলছে, ভাড়া সমন্বয়ের আশ্বাস পেলে ধর্মঘট তুলে নেওয়া হবে। দুই–একদিনের মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠক হতে পারে বলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকনেতারা জানিয়েছেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনো ঘোষণা কিংবা সরকারি নির্দেশনা ছাড়াই বাড়তি ভাড়া আদায় করায় দিনভর বাসে ও কাউন্টারে যাত্রীদের সঙ্গে বাস কন্ডাক্টরদের বাকবিতণ্ডা, ঝগড়া ও হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। হঠাৎ ভাড়া বাড়ানো নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক যাত্রী। বাস স্টাফরা তাদের ইচ্ছামতো ভাড়া নির্ধারণ করেছেন। এতে বিপাকে পড়েছেন যাত্রীরা।
জ্বালানির দাম এমন সময় বাড়ল, যখন বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, মুরগির মাংস, সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেশি। করোনাকালে মানুষের আয় কমেছে। গতকালই বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসি ও বিআইজিডি জরিপের তথ্য তুলে ধরে জানায়, দেশে করোনাকালে নতুন দরিদ্র হয়েছে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ।
বাস স্টাফরা বলছেন, সরকার তেলের দাম বাড়িয়েছে। এতে আগের চেয়ে আমাদের খরচ বেড়েছে। বাড়তি খরচ মেটাতে বাড়তি ভাড়া নেয়া হচ্ছে। গতকাল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে সরকারি নির্দেশনা ছাড়াই জনপ্রতি ১৪ টাকা বেশি আদা করেছে পরিবহনগুলো। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বন্ধন ও উৎসব পরিবহনের মালিকরা ৩৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকা করে ভাড়া আদায় করেছেন। এছাড়া শীতল পরিবহনে ৫৫ টাকার ভাড়ার বিপরীতে ৬৫ টাকা আদায় করা হয়েছে। যদিও একই রুটের অন্যান্য পরিবহনে আগের ভাড়াতেই যাত্রীরা যাতায়াত করছেন। এছাড়া তেলের বিপরীতে এসব বাস গ্যাসে চলাচল করে।
যাত্রীরা জানান, ডিজেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছেন বাসমালিকরা। এতে অনেককেই বাড়তি ভাড়া নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে। এ নিয়ে যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া দিতে অস্বীকার করলে তাদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। প্রকাশ্যে বাড়তি ভাড়া নিলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বাড়তি ভাড়া আদায় করা পরিবহনের স্টাফরা বলছেন, মালিক পক্ষ ভাড়তি ভাড়া আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তেলের দাম মেটাতে নেয়া হচ্ছে এই বাড়তি ভাড়া।
জ্বালানির দাম এমন সময় বাড়ল, যখন বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, মুরগির মাংস, সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেশি। করোনাকালে মানুষের আয় কমেছে। গতকালই বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসি ও বিআইজিডি জরিপের তথ্য তুলে ধরে জানায়, দেশে করোনাকালে নতুন দরিদ্র হয়েছে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, পূর্ব কোনো ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ ডিজেল ও কেরোসিনের লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়ায় জনজীবনে এর প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে পরিবহন, কৃষি ও বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বাড়বে। সাধারণ মানুষের আয়ের ওপর এটা ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। করোনায় অর্থনৈতিকভাবে দেশের মানুষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এর মাঝে ডিজেল ও কেরোসিনের নতুন দাম নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষদের নতুন করে চাপে ফেলবে।
তারা বলছেন, ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ায় নিশ্চিতভাবেই পরিবহন খরচ বাড়বে। আর পরিবহন খরচ বাড়লে পণ্যের দামে এর প্রভাব পড়বে। করোনার কারণে দেশের সাধারণ মানুষের আয়ের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে, অনেকের ব্যবসাও বন্ধ হয়েছে। এর বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টার মধ্যেই জ্বালানি তেলের এই দামের প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর চাপ তৈরি করবে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, জ্বালানি তেল হলো একটি ‘কৌশলগত পণ্য’। তেলের দাম বাড়লে তা সরাসরি মানুষের যাতায়াত খরচ বাড়িয়ে দেয়। পরোক্ষভাবে কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও সব পণ্যের পরিবহন ব্যয় বাড়ে। যার প্রভাব পড়ে পণ্যের দামে। ফলে আগামী দিনগুলোতে সব ধরনের পণ্যের দাম কিছু কিছু বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানির দাম বাড়লে মূল্যস্তরে প্রভাব পড়ে। এর কারণে স্থির আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, সমস্যা হলো, দেশে জ্বালানি তেলের কারণে যতটুকু খরচ বাড়ে, তার চেয়ে ভাড়া অনেক বেশি বেড়ে যায়।
জ্বালানি তেলের ওপর যে শুল্ক আছে, সেখানে ছাড় দিয়ে দাম আরেকটু কম হারে বাড়ানো যেত বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, অন্য নিত্যপণ্যে শুল্ক ছাড় দিয়ে এবং কৃষকের জন্য ভর্তুকি বাড়িয়ে নেতিবাচক প্রভাব সীমিত রাখা যেতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৫
আপনার মতামত জানানঃ