সম্প্রতি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে (বিএসএফ) অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকার তিনটি রাজ্যে সীমানার ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত গ্রেপ্তার, তল্লাশি এবং জব্দ করার ক্ষমতা পাবেন বিএসএফ কর্মকর্তারা। সেই ক্ষমতারই যেন বহিঃপ্রকাশ পেল বাংলাদেশের রাণীশংকৈল সীমান্তে।
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী (বিএসএফ) ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার জগদল সীমান্তে বাংলাদেশের ভেতর থেকে এক কৃষককে ধরে নিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে। নির্যাতনের শিকার রুহুল আমিনকে (৩৭) ঠাকুরগাঁওয়ের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি সেখানেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড় ইউনিয়নের ভদ্রেশ্বরী ভেলাপুকুর গ্রামের মৃত আক্কেল আলীর ছেলে।
চিকিৎসারত রুহুল আমিন জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, ‘গতকাল সোমবার সকাল ৮টার দিকে কুলিক নদীর পশ্চিম পাশে জগদল সীমান্তের ৩৭৪/১-এস পিলারের কাছে বাংলাদেশের প্রায় ২০০ গজ ভেতরে জহুরুল ইসলামের জমি চাষ করতে যাই। সকাল ১০টার দিকে সাদা পোশাকধারী ২ বিএএফ সদস্য মাছ ধরতে ওই নদীতে আসেন।‘
‘জমিতে কী আবাদ করা হবে এমন কথার এক পর্যায়ে তারা কাছে এসে গলায় চাকু ধরে ভারতের ভেতরে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে নিয়ে যায়।
‘সেখানে আরও ৩ বিএসএফ সদস্য তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাতে শুরু করে। এভাবে প্রায় ১৫ মিনিট পেটানোর পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
‘পরে জ্ঞান ফিরলে শুনি নদীর ওপারে ভারত সংলগ্ন এলাকায় চাষাবাদ করতে না যাওয়ার জন্য অন্যান্য বাংলাদেশিদের হুঁশিয়ার করে বিএসএফ সদস্যরা। অন্যথায় এর চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি হবে বলে হুমকি দেয়।‘
পরে নদীর কাছে কোন রকমে এলে স্থানীয়রা আনুমানিক দুপুর দেড়টার দিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে,’ যোগ করেন তিনি।
প্রথমে নেকমরদ বাজারে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে স্বজনরা সন্ধ্যায় ঠাকুরগাঁওয়ের একটি ক্লিনিকে রুহুল আমিনকে ভর্তি করেন।
জমির মালিক জহিরুল ইসলাম ওই দৈনিককে বলেন, ‘প্রায় ১৫/২০ বছর ধরে জমিটিতে চাষাবাদ করছি। কখনো কোনো ঝামেলা হয়নি। নতুন করে ওই জমিতে আলু লাগানোর জন্যে রুহুল আমিনকে চাষ দিতে বলা হয়। রুহুল আমিন আমার জমিতে চাষ করছিল। সেসময় বিএসএসফ সদস্যরা তাকে ধরে নিয়ে ভারতের কাঁটাতারের বেড়ার কাছে নিয়ে গিয়ে ব্যাপক নির্যাতন করে।‘
কাঠালডাঙ্গী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কোম্পানি কমান্ডার মো. আবুল হোসেন বলেন, ‘এ ব্যাপারে গতকাল বিকেলে একই সীমান্তে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বিজিবি-বিএসএফের মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিএসএফকে আমরা মৌখিকভাবে ঘটনার প্রতিবাদ জানাই। সেসময় বিএসএফ সদস্যরা জানায়, রুহুল আমিন মহিষ নিয়ে ভারতের ভেতরে প্রবেশ করেছিল। তারা ঘটনাটি তদন্ত করে দেখবে বলে জানিয়েছে।‘
সীমান্তে বিএসএফ-এর আচরণ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। বিএসএফের ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে সেই বিতর্ক আরো বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, বিশেষত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ-এর ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।
সীমান্তে বিএসএফ-এর আচরণ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। বিএসএফের ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে সেই বিতর্ক আরো বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, বিশেষত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ-এর ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।
এছাড়া সীমান্তে পাচারের সাথে বিএসএফ যুক্ত, এমন অভিযোগ এর আগেও উঠেছে। কিছুদিন আগে বিএসএফের এক অফিসার পশ্চিমবঙ্গে ধরাও পড়েছেন। এ ছাড়াও সীমান্ত হত্যার অভিযোগও বারবার উঠেছে বিএসএফর বিরুদ্ধে। সীমান্ত হত্যার অভিযোগ বাংলাদেশ যেমন তুলেছে, তেমনই ভারতে সীমান্তে বসবাসকারী নাগরিকরাও তুলেছেন। বিএসএফের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়ার ফলে এই বিতর্ক আরো বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে উন্নতি ঘটলেও তার প্রতিফলন দেখা যায়নি দুই দেশের সীমান্তে। সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুই দেশের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা হলেও তাতে সীমান্ত পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেনি। এমনকি সীমান্তে প্রানঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার ব্যাপারে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে ঐক্যমত্য থাকলেও তা প্রায়ই লঙ্ঘন হতে দেখা যায়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘সীমান্তের হত্যা কমবে না, সংখ্যাটাও নিচে নামবে না। কারণ, ভারতের বিএসএফকে আমি সবসময় ট্রিগার হাতেই দেখি। তারা গুলি করার জন্য প্রস্তুত থাকে। আগে গুলি করে, পরে কথা বলে।’
তিনি বলেন, ‘বিএসএফের বেশিরভাগ সদস্যই অবাঙালি। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তারা এখনো মনে করে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুধার্ত, বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশ। তাই তারা ভারতে যায়। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। বিষয়টি ভারতের পলিটিক্যাল লেভেল (রাজনৈতিকভাবে) থেকে বিএসএফকে সেভাবে বার্তা দেওয়া হয় না অথবা বিএসএফ তাদের কথা শোনে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার মতে, যদি ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চায়, তাহলে তাদের নিচের লেভেলে (বিএসএফ) অ্যাকশন নিতে হবে। তবে এ ধরনের অ্যাকশন তারা আগে কখনো নেয়নি। এমনকি ফেলানীর ঘটনায়ও কিছু হয়নি। পলিটিক্যাল লেভেল থেকে শক্ত বার্তা না দিলে সীমান্তে হত্যার কোনো সুরাহা হবে না। এ হত্যাকাণ্ড বাড়তে থাকলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব আরও প্রকট হবে’।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর আবু আহমেদ ফয়জুল কবির অনলাইনভিত্তিক এক দৈনিককে বলেন, ‘বিএসএফ দ্বারা হত্যার পর কোনো বাংলাদেশির কাছে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেছে— এমন কোনো নজির বা ঘটনা নেই। যারা মারা যান, তাদের শতভাগই নিরীহ (ইনোসেন্ট)। যেহেতু বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে কোনো অস্ত্র থাকে না সেক্ষেত্রে বিএসএফ সদস্যরা তাদের আটক করে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা নির্যাতন ও গুলি চাই না। এমনকি সীমান্তে ভারতের অনুপ্রবেশকারী নাগরিক থাকলে বিজিবি তাদের আটক করে ফিরিয়ে দেয়, হত্যার নজির নেই। অথচ আগ্নেয়াস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও বিএসএফ বাংলাদেশিদের হত্যা করছে। বিএসএফের উচিত বাংলাদেশ ও ভারতের ঐতিহ্যবাহী সম্পর্কের কথা বিবেচনায় নিয়ে নমনীয় আচরণ করা।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪০
আপনার মতামত জানানঃ