গত ১৩ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে কোরআন অবমাননার অভিযোগ ওঠে, যার জেরে দেশজুড়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মণ্ডপ, মন্দির, বাড়িঘর এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। সহিংসতার ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে চাঁদপুরের চারজন রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে গত রোববার আবারও একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কমপক্ষে ২৯টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে। এমনকি সিঁদুর মাথায় বের হতে ভয় পাচ্ছেন নারীরা।
হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে বলেছেন, এখন তাদের বাংলাদেশে নিরাপদে বসবাস করা বা নিরাপত্তার প্রশ্নে শঙ্কা আরও বেড়েছে।
অন্যদিকে মুসলিমরাও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। চাঁদপুরে মুসলমিদের একটি মিছিল থেকে মন্দিরে হামলা করার সময় পুলিশের গুলিতে পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
আতঙ্কে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়
বিবিসি বাংলার প্রতিনিধি বলেন, নোয়াখালীর চৌমুহনী এবং কুমিল্লায় সহিংসতার শিকার হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু মানুষের সাথে আমি কথা বলেছি। তাদের চোখে মুখে যেমন ভয় বা আতঙ্ক দেখেছি, তেমনি তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে এমনও দেখেছি।
চৌমুহনীতে ইসকন মন্দিরে হামলার ঘটনার পরদিন প্রান্ত দাশ নামের এক যুবকের মৃতদেহ পাওয়া যায় একটি পুকুরে। তার মা বনলতা দাশ সেখানে গিয়ে ছেলের মৃতদেহ শনাক্ত করেন।
সেই ইসকন মন্দিরে গত মঙ্গলবার যখন কথা বলেছি, তখন দেখেছি, ছেলের সারা শরীরে কোপাকুপির আঘাতের চিহ্ন থাকা মৃতদেহ দেখে তিনি কীভাবে শোকে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। একদিকে তার ছেলে হারানোর বেদনা, অন্যদিকে এই ঘটনার পর ভবিষ্যত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে তার মনে।
যখন চৌমুহনীতে ইসকন মন্দিরে হামলা হচ্ছিল, তখন মন্দিরের লোকজন ট্রিপল নাইনে এবং পুলিশের কাছে ফোন করে কোন সাড়া পাননি। তাদের মধ্যে চরম আতঙ্ক এবং একইসাথে ক্ষোভ দেখা গেছে।
মন্দিরটির অধ্যক্ষ রসপ্রিয় দাশ বিবিসি বাংলার ওই প্রতিনিধিকে বলেছেন, এই হামলার ঘটনায় আমাদের মধ্যে এতটাই আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে যে, এই মন্দিরে থাকা ভক্তরা এখান থেকে চলে যেতে চাচ্ছে। আমরা তাদের সাহস দিয়ে আটকিয়ে রেখেছি।
একই সাথে তিনি বলছেন, এখন পুলিশ দিয়ে মন্দির পাহারা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু পুলিশ যখন থাকবে না, তখন তারা কীভাবে মন্দিরে থাকবেন?
১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরটি নিয়ে এখন তাদের মধ্যে এমন উদ্বেগ বাড়ছে বলে উল্লেখ করেন রসপ্রিয় দাশ।
মন্দিরটি অনেক পুরনো। তবে এক দশক আগে ইসকন এর দায়িত্ব নিয়েছে।
নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একজন নারী বলেছেন, তিনি এখনকার পরিবেশে ঘর থেকে বের হতেই ভয় পাচ্ছেন।
ওই নারী বলেন, ধরেন, আমি ঘরের বাইরে বের হব। আমার কোন নিরাপত্তা নেই। এখন আমার হাতে শাখা আছে, সিঁদুর আছে। এগুলো নিয়ে আমি কীভাবে বের হব?
তিনি মনে করছেন, তাদের পুরুষদের ধর্মীয় কোন চিহ্ন শরীরে থাকে না। ফলে তারা বের হয়ে কাজকর্ম করার চেষ্টা চালাতে পারে। কিন্তু নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
চৌমুহনীতে কাছাকাছি দূরত্বেই কয়েকটি মসজিদ এবং মন্দির রয়েছে। সেখানে সহিংসতার ঘটনায় মুসলিমদেরও অনেকে অবাক হয়েছেন। তারাও মনে করেন, যুগ যুগ ধরে যেখানে সম্প্রীতির পরিবেশ ছিল, সেখানে এখনকার ঘটনায় পরিবেশটাই ওলটপালট হয়ে গেছে।
রংপুরের পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুরের এক ব্যক্তির কথিত একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে গত রোববার সন্ধ্যার পর সেখানকার মাঝিপাড়ায় সহিংসতা চালানো হয়। প্রায় ৭০টি পরিবারের বাড়িঘর লুটপাট ও বেশ কিছু ঘরে আগুন দিয়েছে সংগঠিত দুর্বৃত্তরা। মাঝিপাড়া এখন আতঙ্কিত জনপদ।
ধরেন, আমি ঘরের বাইরে বের হব। আমার কোন নিরাপত্তা নেই। এখন আমার হাতে শাখা আছে, সিঁদুর আছে। এগুলো নিয়ে আমি কীভাবে বের হব?
কমলী রানী উচ্চকণ্ঠে প্রথম আলোকে বলছিলেন, সবাই চলি গেইলে হামার বাড়িত ফির যদি হামলা হয়, হামারা কী করমো? হামরা কি এ দেশোত ভালো থাইকপার নই?’
রোহিনী চন্দ্র দাস সন্ধ্যার পর চোখে দেখেন না। বাড়ির অন্য সবাই ঘর থেকে দ্রুত পালিয়ে গেলেও তিনি পালাতে পারেননি। তাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। জীবনসায়াহ্নে নিজের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন, দুর্বৃত্তরা তার বাড়ি লুট করছে, কেরোসিন ঢেলে তার ঘরে আগুন দিচ্ছে।
রোহিনী বলছিলেন, ‘সারা জীবনে এমন দেখি নাই। সন্ধ্যার পর মানুষ চিনবার পাই নাই। মানুষ আর মানুষ, হাজার হাজার মানুষ।’
রোহিনীর ছেলেবউ সোনালি দাস জানালেন, অন্য সবাই মিলে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ধানখেতে শুয়ে ছিলেন কয়েক ঘণ্টা। শুধু সোনালি দাসের পরিবার নয়, মাঝিপাড়ার সবাই জীবন বাঁচানোর তাগিদে সেদিন আশপাশে থাকা সবুজ ধানখেতেই শুয়ে আত্মগোপন করে ছিলেন। যারা পালাতে দেরি করেছে, তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া বৃষ্টি রানীও পালিয়ে ধানখেতে আশ্রয় নিয়েছিল।
চাঁদপুরে মুসলিমদের ক্ষোভ
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে আবার মুসলিমদের মাঝে ক্ষোভ দেখা গেছে সেখানে বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনা নিয়ে।
কুমিল্লায় যেদিন কোরআন পাওয়া যায়, সেদিনই রাতে বিক্ষোভ মিছিল থেকে মন্দিরে হামলার সময় পুলিশের গুলিতে পাঁচজন নিহত হয়। এই নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই কিশোর ও তরুণ। নিহতদের স্বজনরা বিচার চাইছেন। কিন্তু তারা মামলা করেননি।
তারা মনে করেন, ঘটনার তদন্ত এবং বিচার করার দায়িত্ব সরকারের।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা হচ্ছে।
তবে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত নোয়াখালী, কুমিল্লা এবং চাঁদপুরের আওয়ামী লীগের দলীয় একাধিক সংসদ সদস্য বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এবারের ঘটনাগুলো হিন্দু সম্প্রদায়কে বেশি আতঙ্কিত করেছে— এ নিয়ে তাদের দলের ভেতরেও আলোচনা চলছে।
ধর্মের নামে দেশে এ রকম অর্গানাইজড ক্রাইম এই প্রথম নয়। আগেও ঘটেছে কক্সবাজারের রামুতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, সুনামগঞ্জের শাল্লায়। কিন্তু কোথাও এদের বিচার হয়নি। উল্টো সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর মামলার চার্জশিটভুক্ত ৩ আসামি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পায়।
প্রশাসনের ব্যর্থতার অভিযোগ
কুমিল্লায় গত ১৩ই অক্টোবর পূজামণ্ডপে কোরআন পাওয়ার পর সেখানে পূজামণ্ডপে বা মন্দিরে হামলার ঘটনা ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে পুলিশ এবং স্থানীয় রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ এসেছে।
এর দু’দিন পর ১৫ই অক্টোবর শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর চৌমুহনীতেও পূজামণ্ডপ, মন্দির এবং হিন্দুদের বাড়িঘর-ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনার ক্ষেত্রে প্রশাসনের ব্যর্থতার কথা এসেছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে বলেছেন, বাংলাদেশ এখন তাদের জন্য কতটা নিরাপদ— সেটা তাদের বেশি ভাবাচ্ছে।
চৌমুহনীতে পূজা উদযাপন পরিষদের নেতা তপন চন্দ্র মজুমদার কিছুটা ক্ষোভের সাথে বিবিসি বাংলাকে বলেন, হামলার সময় তিন ঘন্টায় তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, পুলিশ বা প্রশাসনের কোন সাহায্য পাননি।
তিনি বলেন, সেদিনের ঘটনায় আমরা মনে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি। আমরা আদৌ আঘাত পুষিয়ে সামনে এখানে থাকতে পারবো কিনা— এটা আমার কাছে সন্দেহ হচ্ছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে বলেছেন, ১৯৪৭ সালের দাঙ্গার পর এই প্রথম চৌমুহনীতে হিন্দুদের টার্গেট করে সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে তাদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা বা কাজকর্ম একেবারে থমকে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া, এটাই তাদের পরবর্তী অপরাধে সাহস যোগায়। শাল্লার ঘটনায় আমরা দেখলাম উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিবাদকারী যুবক ঝুমন দাস হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখায় আটক হয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও সহজে জামিন পাননি। কিন্তু অপরাধে সম্পৃক্ত স্বাধীন মেম্বাররা অনায়াসে ছাড় পেয়ে গেছেন। অথচ দেশজুড়ে হেফাজতি তাণ্ডবের জেরে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রই মামলা করে আটক করে রেখেছে।
তারা বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের চোখ দিয়ে দেখলে সংখ্যালঘুর মন বোঝা যায় না। বিপরীত দিক থেকে ভাবলেই কিছুটা আন্দাজ করা যায়। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা যদি ভাবতেন যে তাদের ঈদ আনন্দের সময় শহরজুড়ে, পাড়াজুড়ে পাহারা দিচ্ছে পুলিশ, বিজিবি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিছু ধর্মোন্মাদ মানুষ একটা হুজুগ তুলে যেকোনো সময় হামলা করতে পারে। কেমন লাগতো তখন? সশস্ত্র পাহারা দিয়ে হয়তো সাময়িক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, কিন্তু আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশ তৈরি করা যায় না।
আরও বলেন, রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনায় প্রথম ও প্রধান শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। রাজনীতির হিসাব-নিকাশে বড় হয়ে ওঠে কারা তাদের ভোট পাবে, কারা পাবে না। নিরাপত্তা নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে। নব্বই ও বিরানব্বইয়ের পর ২০০১ সালে এবং রামু, সাথিয়া, নাসিরনগরের ঘটনায় এর প্রমাণ মিলেছে। নির্বাচিত দল বা সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ঐ সময়ের বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বিশ্বসম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতে হয়েছে।
আমাদের দেশে যে কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় রাজনৈতিক মাঠ গরম থাকে বেশ কিছু দিন। পক্ষে-বিপক্ষে, অভিযোগ পাল্টা-অভিযোগ চলতেই থাকে। সকল সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, সুশীল সমাজ রাস্তায় নামে এবং প্রতিকার খোঁজার চেষ্টা করে। তেমন সমাধান পাওয়া যায় না। মামলা হয়; কিন্তু বিচার হয় না। ফলে থামছে না নির্যাতনের ঘটনাও। অভিযোগ, নেপথ্যে ক্ষমতাসীনরা জড়িত থাকায় তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যায় না। এবারের ঘটনাতেও ক্ষমতাসীনদের জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, অপরাধী যেই হোক, তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে’— এরকম আপ্তবাক্য মানুষ আর শুনতে চায় না। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত কোনো সংখ্যালঘু হামলা মামলার বিচার হয়নি, এটাই সত্য। ফলে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর জান-মালের নিরাপত্তার কোনো সুরাহা হয় না। নিরাপত্তাহীনতা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
এ দেশের সকল ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য। এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি যুদ্ধ করে অর্জন করা। সেই মাটির অধিকার আমাদের সকলের। কেবল ধর্মের কারণে সেই অধিকারবোধ নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। যে কোনো মূল্যে এই ঐক্যের বোধ জাগ্রত রাখতে হবে। উন্নয়নের প্রকৃত সোপান সেখানেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৩
আপনার মতামত জানানঃ