বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশের তালিকায় অবস্থান করছে। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ের তুলনায় বর্তমানে ধান উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ। তবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতি বছরই আমদানি করতে হয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাদ্যশস্য। ক্রমাগতই বাড়ছে এ আমদানির পরিমাণ। দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৬ লাখ টন চাল আমদানি হয়। আমদানি মূল্যের ওপর নির্ভর করে স্থানীয় বাজারে পণ্যটির দামের স্থিতিশীলতা। অথচ দেশে প্রতি বছর গড়ে ৬৭ লাখ টন চাল নষ্ট হয়। এর মধ্যে দেশে বছরে ছয় লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন চাল ‘বিলাসিতা’য় নষ্ট হয়। সামাজিক অনুষ্ঠান, গৃহস্থালি পর্যায়ে পরিবেশনসহ বিভিন্নভাবে এ অপচয় হয়। বিলাসিতায় নষ্ট হওয়া এ চাল দিয়ে চার হাজারের বেশি মানুষের সারা বছরের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। একটু সচেতন হলেই বিপুল পরিমাণ এই চাল বিনষ্টের হাত থেকে বাঁচানো যায়।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি সংসদীয় কমিটিতে দেশে চাল উৎপাদন ও ব্যবহার বিষয়ক গবেষণা তথ্যটি ডিজিটাল পদ্ধতিতে উপস্থাপন করেছে ব্রি।
গবেষণায় ব্রি বলেছে, দেশের মানুষ যে চাল খায় (হিউম্যান কনজাম্পশন) তার মধ্যে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ গৃহস্থালি পর্যায়ে অপচয় হয়। অপচয়ের মধ্যে খাদ্য সংগ্রহ ও প্রস্তুতি পর্যায়ে ৩ শতাংশ, পরিবেশন পর্যায়ে ১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং প্লেটে অপচয় ১ দশমিক ১ শতাংশ। গৃহস্থালি পর্যায়ে অপচয়ের প্রধান কারণ অজ্ঞতা ও বিলাসী মানসিকতা বলে ‘ব্রি’ তার গবেষণায় উল্লেখ করেছে।
জানা গেছে, ১৭ কোটি মানুষ হিসাবে গেল বছর দেশে ভোগ্য-চালের চাহিদা ছিলো দুই কোটি ৫২ লাখ মেট্রিক টন। ব্রি’র গবেষণার তথ্য অনুযায়ী এই ভোগ্য-চালের মধ্যে গৃহস্থালি পর্যায়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অপচয় হলে মোট অপচয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৮৬ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে খাদ্য সংগ্রহ ও প্রস্তুতি পর্যায়ে ৩ শতাংশ অপচয়ের হিসাবে চালের পরিমাণ দাঁড়ায় সাত লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন। আর পরিবেশন ও প্লেট পর্যায়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হিসাবে অপচয় হয় ছয় লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। সংগ্রহ ও প্রস্তুতি পর্যায়ের অপচয় অজ্ঞতা এবং পরিবেশন প্লেট পর্যায়ের অপচয় বিলাসিতার কারণে হয় বলে ব্রি গবেষণায় উল্লেখ করেছে।
ব্রি’র তথ্য মতে, গৃহস্থালি পর্যায়ে চালের যে অপচয় হয় তা দিয়ে ৯ হাজার ৩৭৬ জন মানুষের সারা বছরের খাবারের জোগাড় হয়ে যায়। অপরদিকে বিলাসিতার কারণে যে পরিমাণ অপচয় হয় তাতে চার হাজার ২৬২ জন মানুষের বছরের খাবার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
সরকারি হিসাব মতে, জনপ্রতি দৈনিক চালের চাহিদা ৪০৫ গ্রাম। সেই হিসেবে বছরে জনপ্রতি চালের দরকার পড়ে ১৪৭ কেজি ৮২৫ গ্রাম।
গৃহস্থালি পর্যায়ে চালের যে অপচয় হয় তা দিয়ে ৯ হাজার ৩৭৬ জন মানুষের সারা বছরের খাবারের জোগাড় হয়ে যায়। অপরদিকে বিলাসিতার কারণে যে পরিমাণ অপচয় হয় তাতে চার হাজার ২৬২ জন মানুষের বছরের খাবার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ৬৭ লাখ টন চাল নষ্ট হয়। এ ক্ষতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা গেলে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টন বাড়তি চাল পাওয়া সম্ভব। অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে এ পর্যন্ত বার্ষিক সর্বোচ্চ চাল আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৯ লাখ টন। এ বছরও প্রায় ৩০ লাখ টন চাল আমদানি করছে সরকার। এর মধ্যে আগে এসেছে ১৩ লাখ টন।
নতুন করে ১৭ লাখ টন চাল আমদানি প্রক্রিয়াধীন। সে অনুযায়ী উৎপাদিত ধান-চাল নষ্ট হওয়ার মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব হলে প্রকৃতপক্ষেই চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করত দেশ।
দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ— সরকারিভাবে এমন দাবি করা হলেও ১৭ কোটির বেশি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখনো অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে প্রতি বছর চালসহ বিপুল পরিমাণ খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয় কেন? তাদের মতে, সরকারি হিসাবে ভুল তথ্য অথবা গোজামিল রয়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, যে কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের খাদ্য নিরাপত্তায় সরকারিভাবে কমপক্ষে ৬০ দিনের খাদ্য মজুত রাখা প্রয়োজন। আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর একদিনের খাদ্য চাহিদা প্রায় ৪৬ হাজার টন। সে হিসাবে ৬০ দিনের জন্য খাদ্য মজুত রাখার কথা ২৭ লাখ টন। সেখানে সরকারের কাছে খাদ্য মজুত রয়েছে ১৮ লাখ ১৪ হাজার টন। যা সাম্প্রতিক সময়ের রেকর্ড পরিমাণ মজুত। তবে বাংলাদেশের মানুষের ঘরে, মিল ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় খাদ্যপণ্য যথেষ্ট মজুত রয়েছে বলে মনে করে সরকার। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন ব্যবস্থা নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যশস্যের কৌশলগত মজুতের জন্য চাল আমদানি করা যেতে পারে। তবে সেটা কোনোভাবেই মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশের বেশি নয়। মোট আমদানির পরিমাণ মোট উৎপাদনের ২০ শতাংশের বেশি হলে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ঝুঁকি তৈরি হয়। বেশি আমদানি করলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। খাদ্যশস্য উৎপাদনের জমির উৎপাদিকা শক্তি বেশ গুরুত্বপূণ। আমদানি নির্ভরতা কমাতে হলে ফলন বাড়ানোর বিকল্প নেই। সেজন্য শস্যের জাতের উন্নয়ন ও মানসম্মত বীজ সরবরাহ বাড়ানো, মাটির স্বাস্থ্য, বালাই ব্যবস্থাপনা ও কৃষিতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া, স্থানীয় সেবা প্রদান ব্যবস্থা উন্নয়ন করতে হবে। এছাড়া বাজার ব্যবস্থা, কৃষি গবেষণা ও যান্ত্রিকীকরণের উন্নয়ন, বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণ কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চালের এ ধরনের অপচয়ের কারণে দেশের অর্থ ও সম্পদের অপচয় হচ্ছে। এটি দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে এসডিজির যে পরিকল্পনা রয়েছে সেটি বাধাগ্রস্ত করবে। অপচয় রোধে রাষ্ট্রের উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন।
তারা বলেন, ধান থেকে চাল এবং চাল থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর নানান পর্যায়ে বড় একটি অংশ অপচয় হচ্ছে। সেটি কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রের উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে কাজ করা হচ্ছে। পাশাপাশি যেসব অপচয় হচ্ছে, সেগুলোর বিকল্প ব্যবহার বাড়ানোর উপায় নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। বিশেষ করে চাল থেকে স্টার্স, ফিশারিজ ও পশুখাদ্য হিসেবে বিকল্প ব্যবহার করার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। তবে মাঠ পর্যায়ে আরো যান্ত্রিকীকরণ করতে হলে কৃষক ও জমি উপযোগী যন্ত্রের ব্যবহার আরো বাড়াতে হবে। আবার আর্দ্রতা পরিমাপের জ্ঞান কৃষকের মাঝে ভালোভাবে সম্প্রসারণেও যন্ত্র পৌঁছানো হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ