বাংলাদেশে আবহমানকাল থেকে ঢেঁকির মাধ্যমে প্রক্রিয়া করে ধান থেকে চাল উৎপাদন করা হয়। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের আধুনিকায়নের ফলে কলের বা মেশিনের মাধ্যমে চাল ভাঙা শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের পর পরই। ১৯৮০ সালের পর নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি ব্যাপক উন্নতি ও প্রসার লাভ করে। শিল্পোন্নয়নের ডামাডোলে দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে এখন পরিবর্তন ঘটছে। দেশে সাদা চালের চাহিদা বেড়েছে। এ কারণে সাদা চালের ধানের জাত ও চাল সাদা করার মেশিনের উদ্ভাবনও হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশসহ সব চাল উৎপাদনকারী এশীয় দেশেই প্রক্রিয়াজাত সাদা চাল অত্যন্ত জনপ্রিয়। কয়েক দশক ধরেই এসব দেশে চাল প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। মিলিং, সেদ্ধকরণ ও দ্রুত সেদ্ধকরণ, চাল শুকানো, গুদামজাত ইত্যাদি ধাপ বিবেচনায় নিয়ে সাদা চাল প্রক্রিয়াকরণের নানা উপায় উদ্ভাবন হচ্ছে। দেখতে সুন্দর, খেতে সুস্বাদু বিধায় বর্তমানে ধনী-গরিব নির্বিশেষে দেশের বেশির ভাগ মানুষ সাদা চালের ভাত গ্রহণ করছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক কালের বিভিন্ন গবেষণায় সাদা ও পলিশ করা চালের বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব উঠে এসেছে। গবেষণাগুলোয় বলা হয়, এসব চাল বেশি গ্রহণের সঙ্গে টাইপ ২ ডায়াবেটিক মেলিটাস হওয়ার প্রবণতার সরাসরি সম্পর্ক পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামসহ এ চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোয় এ রোগের প্রাদুর্ভাব গবেষণাটির ফলাফলের সপক্ষে সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ।
বাজারে প্রচলিত যে ধারণা রয়েছে যে, মোটা চালকে কেটে সরু করা হয় সেটি আসলে ঠিক নয়। চাল কেটে সরু বা লম্বা করা যায় না। তবে চালকে পরিষ্কার ও ঝকঝকে করার পদ্ধতি রয়েছে যাকে পলিশ বলা হয়।
এই পদ্ধতিতে চালের উপরের যে আবরণটা তুলে ফেলা হয় যার কারণে চালটা চকচকে ঝকঝকে করা হয়। বাজারে চকচকে চালের চাহিদা থাকার কারণে রাইসমিলগুলো এটি করে থাকে। গৃহিনীদের কাছে পাথরবিহীন, এই চকচকে চাল বেশ জনপ্রিয়ও।
এসব চালের মধ্যে রয়েছে মিনিকেট, নাজিরশাইল, বাসমতি ইত্যাদি। এসব চাল মূলত, ইরি-২৮,ইরি-২৯, রঞ্জিত, শম্পাকাটারি, পঞ্চাশ ও অন্যান্য জাতের ধান পলিশ করে বানানো হয়।
অর্থনৈতিক ঝুঁকি
সম্প্রতি বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জনগণকে পলিশ করা চাল না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।ভবৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বলেছেন, ‘যদি আমরা সঠিকভাবে আবাদ করি, আর যদি পলিশ করা চাল খাওয়া কমাতে পারি, তাহলে কিন্তু আমাদের খাদ্য বাহির থেকে আনার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই।’
এক সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে খাদ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, পলিশ করার জন্য বা চাল সিল্কি করার জন্য চালের বাইরের কিছু অংশ নষ্ট হয়। প্রতি ১০০ মেট্রিকটন চালে ৫ মেট্রিকটন চাল কমে যায়। এই হিসাবে এক কোটি মেট্রিকটন চালে ২০-২২ মেট্রিক টন চাল হাওয়া হয়ে যায়।
চালের পলিশ করা এই অংশ ভাত, সুজি কিংবা আটা কোনোভাবেই ব্যবহার করা যায় না বলেও উল্লেখ করেন খাদ্যমন্ত্রী।
কীভাবে পলিশ করা হয় চাল?
রাইসমিল মালিক হাজী আলমগীর হোসনে বলেন, দুই উপায়ে চালকে পলিশ করা হয়। একটি হচ্ছে প্রচলিত পদ্ধতি অর্থাৎ ধান পাকার পর সেটিকে মাড়াই, সিদ্ধ ও রোদে শুকানোর পর হাস্কিং মেশিনে ভাঙানো হয়। এতে ধানের খোলস আলাদা হয়ে চালটা বেরিয়ে আসে।
এই চালের উপরে লাল আবরণ থাকে। সাথে বিভিন্ন ধরণের কাঁকড়-পাথর ও মরা চাল থাকে। এই চাল দেখতেও ঘোলাটে হয়। এই ঘোলাটে বা লালচে চাল বাজার থেকে কিনে সেটিকে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে বাছাই ও পলিশ করা হয়।
“এই চালটা কিনে এনে আমরা মেশিনে দিলে কালো (চাল) আলাদা হয়ে যায়, লাল আমরিট (চাল) আলাদা হয়ে যায়, ভাঙ্গা (চাল) আলাদা হয়ে যায়। আমরা এর সাথে একটা পলিশার বসাই। এইটা উপরের আবরণ ছাইটা দেওয়ার জন্য আমরা এইটা ফ্রেশ কইরা নিয়া আসি।”
এছাড়া অটোমেশিনে আরো সহজেই চাল প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এতে কাঁচা ধান মেশিনে দিলে সেটি প্রক্রিয়াজাত হয়ে সরু চাল হিসেবে বের হয়ে আসে। এই অটোমেটিক মেশিনের সাথে পাথর আলাদা করার মেশিন এবং চাল পলিশার মেশিন যুক্ত করা থাকে।
তবে অনেক সময় মিল মালিকরা চাল চকচকে করার জন্য নানা রকমের রাসায়নিক ব্যবহার করে থাকেন বলেও জানা যাচ্ছে। এরমধ্যে চালকে সাদা করার জন্য ফিটকিরি ব্যবহার করা হয়।
“পাঁচ কেজি পানির সাথে ফিটকিরি মিশাইয়া হালকা স্যালাইন দিয়ে দিলে চালটা পরিষ্কার আরো বেশি হয়।”
আবার অনেক রাইস মিল মালিকরা ইউরিয়া সারের পানি মিশিয়েও চাল সাদা করেন।
হাজী আলমগীর হোসনে বলেন, যে চাল বেশিবার ঘষা হয় সেটি বেশি মসৃন হয়ে পিচ্ছিল ভাব আসে। তবে এতে কোন মোম ব্যবহার করা হয় না।
তিনি বলেন, প্রেসার যত বেশি দিবে, তত চকচক-ঝকঝকা, পিছলা বেশি হবে, আয়নার মতো পরিষ্কার হবে, কেউ চারটা চাপ দিয়ে করে, কেউ দুইটা করে।
চাল পলিশ করার সময় কিছুটা ঘাটতি হয় বলেও জানান তিনি। তার তথ্য অনুযায়ী, ৫০ কেজি চাল পলিশ করলে আধা কেজি ওজন কম হয়।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি
বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে গবেষণার মাধ্যমে অধিক ফলনশীল ধানের জাত মুক্তায়িত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) কর্তৃক যথাক্রমে প্রায় ১০০ ও ২১ টি ধানের জাত উদ্ভাবন হয়েছে। এ জাতগুলোর প্রায় সবই সাদা চালের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যসংবলিত। বর্তমানে বাংলাদেশে ব্রি উদ্ভাবিত বিআর ২৯ (সাদা রঙের চাল, ১৯৯৪ সালে মুক্তায়িত) জাতটি উচ্চফলনশীলতার জন্য বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া পলিশ করা বা মসৃণ সাদা অথবা প্রক্রিয়াজাত মিনিকেট চাল এখন প্রায় সবাই গ্রহণ করছে। এ দুই ধরনের চালের গ্লাইসেমিক সূচক বেশ উচ্চমাত্রার (৭০-এর বেশি)।
প্রসঙ্গত, গ্লাইসেমিক সূচক হলো খাদ্যের গুণগত মান, যার মাধ্যমে ওই খাদ্য গ্রহণ করার পর তা ভেঙে রক্তে গ্লুকোজ সরবরাহের দ্রুততার আপেক্ষিক মাত্রা পরিমাপ করা হয়। খাদ্য গ্রহণ করার দুই ঘণ্টার মধ্যে গ্লুকোজ সরবরাহের মাত্রার ওপর গ্লাইসেমিক সূচককে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো উচ্চমাত্রা (৭০ বা তদূর্ধ্ব), মধ্যম (৫৬ থেকে ৬৯) এবং নিম্ন (৫৫ বা এর কম)।
উচ্চ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স সমৃদ্ধ খাবার বেশি সংখ্যক বার ও অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে দেহে গ্লাইসেমিক লোড বেড়ে যায়। ফলে ভোক্তা ধীরে ধীরে টাইপ ২ ডায়াবেটিস মেলিটাসে আক্রান্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সূত্রমতে, বর্তমানে দেশে ১ কোটিরও বেশি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ১৯৯৫, ২০০০ ও ২০১০ সালে এ রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪, ৫ ও ৯ শতাংশ। দেশে এখন যে হারে এ রোগের প্রকোপ বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে, ২০৩০ সালে তা দেড় কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বিস্ময়ের বিষয় হলো, দেশের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে সচেতনতা অত্যন্ত কম। এমনকি আক্রান্ত মানুষের ৫০ শতাংশেরও বেশি জানে না, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অথচ ডায়াবেটিসকে এখন অন্যান্য অনেক অসংক্রামক রোগ যেমন হূদরোগ, স্ট্রোক, বড়-ছোট রক্তনালির ক্ষতি, কিডনি সমস্যা, দৃষ্টি সমস্যা এমনকি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রশস্ত পথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
চাল সরু করার সময় চালে যদি রাসায়নিক হিসেবে ফিটকিরি বা ইউরিয়া ব্যবহার করা হয় তাহলে সেটির প্রভাব স্বাস্থ্যের উপর পড়ে কিনা সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে পুষ্টিবিদ সৈয়দা শারমিন আক্তার বলেন, ফিটকিরির কোন প্রভাব স্বাস্থ্যের উপর পড়ে না। কারণ পানি বিশুদ্ধ করতেও আমরা অনেক সময় ফিটকিরি ব্যবহার করে থাকি। এটার আসলে দেহের উপর কোন ক্ষতিকর প্রভাব নেই।
বিভিন্ন জাতের ধান থেকে পলিশ করার মাধ্যমে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল তৈরি করা হয়। তবে চাল সরু করার প্রক্রিয়ায় ইউরিয়া ব্যবহার করা হলে সেটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে সতর্ক করেন এই পুষ্টিবিদ। তিনি বলেন, ইউরিয়া হচ্ছে দেহের বর্জ্য পদার্থ। এটা যদি খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে সেটা অবশ্যই ক্ষতির কারণ হবে।
মিল মালিকরা বলছেন, ইদানিং মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। পলিশ করা চালের তুলনায় দেখতে কিছুটা ঘোলাটে হলেও আবরণযুক্ত চালের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এসব চালের স্বাস্থ্যগুণ সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়ার কারণে তারা মোটা এবং ঘোলাটে আবরণযুক্ত চালের দিকেই ঝুঁকছে বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৪৮
আপনার মতামত জানানঃ