সাম্প্রতিক সময়ে গোটা বিশ্বের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে নিতান্তই একটি অণুজীব। নিতান্ত শব্দটা যদিও এর ভয়াবহতার অভিজ্ঞতাকে ম্লান করতে পারবে না এতটুকুও। বলছি করোনাভাইরাসের কথা। শাসন করছে গোটা পৃথিবী। টিকা আবিষ্কার হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ক্রমাগত মিউটেড হয়ে এই মারণ ভাইরাসটি প্রশ্নবিদ্ধ করছে টিকার কার্যকারিতাকে। তাবড়-তাবড় বিজ্ঞানীদের রেখেছে দাঁতের উপর।
তবে প্রাণঘাতী ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়াদের সঙ্গে লড়াই মানব সভ্যতার ইতিহাসে নতুন নয়। আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর আগেও পৃথিবীর ছবিটা ছিল একইরকম। এমনকি পঞ্চম গণঅবলুপ্তির মূলেও ছিল অণুজীবরাই (Prehistoric Microbes)। করোনাভাইরাসে ত্রাহি ত্রাহি দশা হলেও এর থেকেও অনেক বেশি প্রাণঘাতী ভাইরাসের উল্লেখ আছে মানব ইতিহাসে। একবার ভেবে দেখুন, সেই অণুজীবরাই যদি হঠাৎ করে ফিরে আসে আজকের দুনিয়ায়?
হ্যাঁ, শিউরে ওঠার মতোই। প্রাগৈতিহাসিক মাইক্রোবসরা আবার ফিরতে চলেছে পৃথিবীর বুকে। এমনটাই জানাচ্ছেন গবেষকরা। আর তার পিছনে দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন (Climate Change)। সম্প্রতি, বিশ্বের প্রথম সারির বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এ প্রকাশিত গবেষণায় উঠে আসছে সেই তথ্যই।
প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবী থেকে স্মাইলোডন, ম্যামথ কিংবা অন্যান্য বৃহদায়তন প্রাণীদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে মুছে গেলেও গণবিলুপ্তিতে মৃত্যু হয়নি অণুজীবদের। বরং তারা অস্তিত্ব সংকটে পড়েছিল আইস এজের সময়। চাপা পড়ে গিয়েছিল তুষারপাতে। পৃথিবীর দুই মেরু প্রদেশের বরফের তলায় আজও হিমায়িত অবস্থায় রয়েছে সেইসব প্রাণঘাতী মাইক্রোবস। যাদের চরিত্র বৈশিষ্ট্য কিংবা সেগুলি কী ধরনের রোগ সৃষ্টি করতে পারে— সবটাই সম্পূর্ণ অজানা গবেষকদের কাছে।
এমন আশঙ্কার কথাই জানাচ্ছেন অ্যাবেরিস্টউইথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রের মূল লেখক ডঃ আরভিন এডওয়ার্ডস। তার মতে, ১০ লক্ষ বছরের পুরনো এই শীতল মরুর ইতিহাসের সামান্য অংশটুকুই কেবলমাত্র জানি আমরা।
আশঙ্কার বিষয় হল, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দ্রুত হারে গলছে মেরু প্রদেশের বরফের চাদর। যার ফলে প্রাগৈতিহাসিক এইসব অণুজীবরা পুনরায় ফিরে আসতে চলেছে পৃথিবীতে। আর এই আশঙ্কা একেবারেই মিথ্যে নয়। কেননা, গত বছরেই কয়েক হাজার বছর পুরনো হিয়ামিত একটি প্রাণীর দেহ উদ্ধার করেছিলেন গবেষকরা।
বিজ্ঞানীদের ধারণা ঠিক সেভাবেই বরফ গললে নবজীবন পাবে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াও, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তাদের প্রতিরোধ করার মতো উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিকও আজকের পৃথিবীতে উপলব্ধ নয় বলেই অনুমান গবেষকদের।
তবে এখানেই শেষ নয়। মেরু প্রদেশে বরফের তলায় জমে রয়েছে বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক বর্জ্যও। চুল্লিজাত তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে শুরু করে পরিত্যক্ত পারমাণবিক সাবমেরিন, বিমানের সমাধি দেওয়া হয়েছে মেরুপ্রদেশে। তাছাড়াও রাশিয়া এবং আমেরিকার পারমাণবিক শক্তিচালিত বহু পরীক্ষাগার পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এই অঞ্চলে।
বরফের চাদর সরে গেলে বাইরে বেরিয়ে আসবে তারাও। যা আরও বাড়িয়ে দেবে জলবায়ু পরিবর্তনের হার। ফলত, আগামীদিনের পৃথিবী যে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে; সেই সম্ভাবনাই আর সম্ভব হয়ে উঠছে। বিজ্ঞানীদের অনুমান এই সম্ভাবনা সত্যি হলে আগামী ৮০ বছরের মধ্যে মেরু প্রদেশের সমস্ত বরফই গলে জল হয়ে যাবে।
এই বিপর্যয় আটকানোর কোনো পথই আর অবশিষ্ট নেই মানুষের হাতে। কেবলমাত্র উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে মন্থর করা যেতে পারে ধ্বংসের গতি। কিন্তু সেইটুকু উদ্যোগও কি নিচ্ছেন বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রনেতারা?
ক্রমাগত পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়িয়ে চলেছে গ্রিন-হাউস গ্যাসগুলি। আর তার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে মেরু অঞ্চলে। বিগত ৩ দশক ধরেই এই নিয়ে চিন্তিত বিজ্ঞানীরা। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এল আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। উত্তর মেরু অঞ্চলের বরফ গলনের যে হার বিজ্ঞানীরা আন্দাজ করেছিলেন, বাস্তব হার তার প্রায় দ্বিগুণ। এমনকি, এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যে উত্তর-মেরু সাগরের উপর বরফের কোনো আস্তরণ থাকবেই না।
উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু পৃথিবীর উষ্ণতা নিয়ামক নামে পরিচিত। তার কারণ এই দুই অংশে বরফের স্তর। সূর্যের রশ্মি সরাসরি সমুদ্রের জলকে উত্তপ্ত তো করতে পারে না, বরং বরফে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায় মহাশূন্যে। এই বরফের স্তর হারিয়ে গেলে সারা পৃথিবীর উষ্ণতাই বাড়তে থাকবে। আর মেরু অঞ্চলের এস্কিমোদের মতো উপজাতিরা তো সমস্যায় পড়বেনই, বিপন্ন হবে মানব সভ্যতা।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮২৭
আপনার মতামত জানানঃ