যুদ্ধে বিধ্বস্ত ইয়েমেনে ইতোমধ্যে ৫০ হাজার মানুষ খাবারের অভাবে মারা গেছে। আরও দেড় কোটির বেশি মানুষ অনাহারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আরও কমপক্ষে ৫০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে। নতুন ফান্ড না এলে দেশটিতে অক্টোবর থেকে লাখ লাখ মানুষকে খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেওয়া হবে বলে সতর্ক করে জানিয়েছেন জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থার প্রধান ডেভিড বিসলে।
বৃহস্পতিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সংস্থাটির প্রধান ইয়েমেনের মানবিক সংকট নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বলেছেন, এর আগে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিতে (ডব্লিউএফপি) যখন অর্থের অভাব দেখা দিয়েছিল তখন দাতা দেশগুলো এগিয়ে এসেছিল। সে কারণে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইয়েমেনে আমরা দুর্ভিক্ষ ও বিপর্যয় এড়িয়ে যেতে পেরেছিলাম।
তিনি বলেন, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির অর্থ আবার শেষ হয়ে আসছে তাই নতুন ফান্ড না এলে দেশটিতে অক্টোবরে ৩২ লাখ মানুষকে এবং ডিসেম্বরে ৫০ লাখ মানুষকে খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেওয়া হবে।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলে বলেছেন, দেশটির সরবরাহ ব্যবস্থা এখন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত। খাদদ্রব্যের মূল্য প্রতিনিয়ত আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘খাদ্যদ্রবের মূল্যবৃদ্ধি ও জ্বালানি স্বল্পতা নিয়ে পরিস্থিতি এখন বিপর্যয়কর। দুর্ভিক্ষের দরজায় কড়া নাড়ছে এমন মানুষের সংখ্যা ৫০ লাখ। আরও এক কোটি ৬০ লাখ অনাহারের মুখে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ আরও তহবিল না দিলে অক্টোবরের মধ্যে ৩২ লাখ মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে।’
ইয়েমেনে ডব্লিউএফপির মুখপাত্র আন্নাবেল সিমিংটন বলেন, ‘ইয়েমেনের মানুষ দুবেলা খাবার জোটাতে পারছে না। খাদ্যসংকট জটিল আকার ধারণ করলেও এর প্রভাব স্পষ্ট। ইয়েমেনি রিয়ালের মান কমে যাওয়া এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ ইয়েমেনিদের পক্ষে দুবেলা দুমুঠো খাবারের ব্যবস্থা করা অসাধ্য হয়ে পড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমরা যেভাবে ত্রাণসহায়তা দিচ্ছি, আগামী ছয় মাস এটা অব্যাহত রাখতে হলেও আমাদের আরও ৭৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এছাড়া অক্টোবর থেকে ত্রাণ ফুরিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছি আমরা। এছাড়া অতিরিক্ত সহায়তা না আসলে ডিসেম্বরের মধ্যে ৫০ লাখ মানুষকে ত্রাণ দেওয়া বন্ধ হবে।’
ইয়েমেনে অ্যাকশন ফর হিউমিন্যাটি নামে আরেকটি দাতব্য সংস্থার কর্মী অ্যাডাম কেলউইক বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘নিদারুণ’ বলে বর্ণনা করছেন। গত মঙ্গলবার পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর সানার একটি হাসপাতাল পরিদর্শন করে আসা কেলউইক বলছেন, ‘ওই হাসপাতালটি ছিল অনাহার আর অপুষ্টিতে ভরা শিশুতে পূর্ণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই সমস্ত শিশুদের থাকার জন্য তাদের অন্য ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। হাসপাতালটি ছিল কঙ্কালের মতো দেখতে শিশুদের বিছানায় ভরা। এটা ছিল একটা ভয়াবহ দৃশ্য। পরিস্থিতির যে দ্রুত অবনতি হচ্ছে সেটা একদম স্পষ্ট এবং শিশুদের এত মারাত্মক অপুষ্টির কারণ হলো তাদের মায়েরাও অপুষ্টিতে ভুগছে।’
অ্যাডাম কেলউইক আরও বলেন, ‘স্পষ্টতই, এর মানে হল যে তারা (মায়েরা) তাদের শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াতে অক্ষম এবং এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই দিন যাপন করতে হচ্ছে তাদের।‘
তিনি বলেন, এমনকি যেসব ইয়েমেনি পরিবারের আয়ের যথেষ্ট উৎস রয়েছে, তারাও একইরকমভাবে ভয়াবহ খাদ্যসংকটের মুখোমুখি হচ্ছে।’
হাসপাতালটি ছিল কঙ্কালের মতো দেখতে শিশুদের বিছানায় ভরা। এটা ছিল একটা ভয়াবহ দৃশ্য। পরিস্থিতির যে দ্রুত অবনতি হচ্ছে সেটা একদম স্পষ্ট এবং শিশুদের এত মারাত্মক অপুষ্টির কারণ হলো তাদের মায়েরাও অপুষ্টিতে ভুগছে।’
সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান হামলায় হুদাদিয়াহ বন্দর ধ্বংসের পর ইয়েমেনের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অনাহারে মারা যাচ্ছে দেশটির শিশুরা। জাতিসংঘ বলছে, বন্দরটি যদি ব্যবহারের উপযোগী না থাকে, তবে শিশুসহ লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটবে।
ইয়েমেনের সাধারণ মানুষের খাবারের চাহিদা মেটাতে সেই বন্দর দিয়ে ৯৫ শতাংশ খাবার আমদানি করা হতো। সৌদি আরব ও তাদের মিত্রদের বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বন্দরটি দিয়ে আমদানি অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
২০১৫ সালের মার্চে থেকে শুরু হওয়া এই গৃহযুদ্ধে এখন পর্যন্ত আট হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে। শিয়া হুতি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানা দখল করে প্রেসিডেন্ট আবেদ রাব্বো মানসুর হাদিকে ক্ষমতাচ্যুত করে। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন আরব দেশগুলোর জোট সুন্নি শাসক হাদির পক্ষ নিয়ে হুতিদের বিরুদ্ধে লড়ছে। ইরান হুতিদের পক্ষে সমর্থন দিচ্ছে। গৃহযুদ্ধে ইয়েমেনের স্বাস্থ্য, পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর হিসাবে, কলেরায় এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩০০ জন প্রাণ হারিয়েছে। যার এক-চতুর্থাংশই শিশু। দেশটিতে কলেরায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। পানিবাহিত এ রোগ সহজে নিরাময়যোগ্য হলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে সবার জন্য চিকিৎসা নিশ্চিত করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
চলতি বছর এপ্রিলে ইয়েমেনে কলেরাকে মহামারি ঘোষণা করা হয়। কলেরার পাশাপাশি দুর্ভিক্ষের মতো মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে ইয়েমেন।
এদিকে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুরা হাসপাতালে গিয়েও বাঁচতে পারছে না। কারণ হাসপাতালে বিদ্যুৎ নেই। অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি সব ধরনের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ইয়েমেনের একটি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। তিনি আরও বলেন, ‘ক্রমাগত অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু হয়েছে। অপুষ্টিতে ভোগা এসব শিশুরা কেবল দরিদ্র পরিবার থেকেই আসছে না; মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদেরও আমরা চরম অপুষ্টিতে ভুগতে দেখছি। ’
ইয়েমেনে চলছে শিয়া ও সুন্নির ক্ষমতা দখলের লড়াই। সেখানেও ইরান ও সৌদি জোটের সশস্ত্র বিরোধ সুস্পষ্ট। লাখ লাখ ইয়েমেনি নাগরিক হয়ে পড়েছে গৃহহীন। আর এই সংখ্যার ৮০ ভাগই মহিলা এবং শিশু। জাতিসংঘের ভাষ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ইয়েমেন। সেখানকার জনসংখ্যার ৮০ ভাগেরই সহায়তা বা সুরক্ষা প্রয়োজন।
প্রায় ছয় বছর আগে ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিয়েছে। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন বন্ধ হলে ইয়েমেনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ হবে না, তবে এই সিদ্ধান্ত রিয়াদ এবং আবুধাবির নেতাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তা দেবে। ইয়েমেনিদের পাশাপাশি পশ্চিমা কূটনীতিকরাও যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের অভিযানে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর একটি কারণ ছিল, ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির কারণে সৃষ্ট সৌদি আরবের ক্ষোভ সামাল দেওয়া।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৬
আপনার মতামত জানানঃ