বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বরাবরই বিশ্বে টিকা বৈষম্য নিয়ে এক রকম আহাজারি করে আসছেন। বরাবরই বলে আসছেন, ধনী দেশগুলিই নিজেদের হস্তগত করে রেখেছে করোনা টিকা। যার ফলে নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশগুলি তাদের চাহিদামতো টিকা পাচ্ছে না। টিকা বৈষম্যে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই যখন টিকার সংকট চলছে এমনি সময়ে জানা গেল ধনী দেশগুলোতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টিকা। খবর বিবিসি
‘সবার সুরক্ষা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী মহামারী থেকে কেউ সুরক্ষিত নয়’— এটি একটি জনপ্রিয় মন্ত্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ধনী দেশগুলোর নীতিমালার কারণে বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন বর্ণবাদ কভিড-১৯-কে উন্নয়নশীল দেশের মহামারীতে পরিণত করেছে এখন। ফলে বিলম্ব ঘটছে মহামারীর সমাপ্তি এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে।
আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে পৃথিবীর ৭০ ভাগ মানুষকে কোভিডের টিকা দেওয়ার অঙ্গীকার করতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। করোনা টিকা আবিষ্কারের পর থেকে বিশ্বের ধনী দেশগুলো নিজেদের জন্য বিপুল পরিমাণ ডোজ কিনে মজুত করে রেখেছে; যার পরিমাণ তাদের প্রয়োজনের তুলনা অনেক বেশি। মজুত এই টিকার বিশাল এক অংশ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় ফেলে দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
টিকার ক্ষেত্রে পৃথিবীতে এখন যে অসাম্য পরিসংখ্যানে ফুটে ওঠে— তা বিরাট। পৃথিবীর অর্ধেকের সামান্য বেশি মানুষ এখনও এক ডোজ টিকাও পাননি।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, পৃথিবীতে যত কোভিড টিকা উৎপাদিত হয়েছে, তার ৭৫ শতাংশই গেছে বিশ্বের মাত্র ১০টি দেশে। ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট বলছে, এখন পর্যন্ত উৎপাদিত ভ্যাকসিনের অর্ধেকই গেছে পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশের কাছে।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোতে টিকা দেয়া হয়েছে দরিদ্র দেশগুলোর চেয়ে ১০০ গুণ বেশি।
গত জুনে জি-সেভেনের সদস্য— কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকার করেছে যে আগামী এক বছরে দরিদ্র দেশগুলোকে ১০০ কোটি ডোজ টিকা দান করা হবে। সাবেক কূটনীতিক, টিকা সরবরাহ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনের প্রণেতা ও ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্সের আগাথা ডেমারাইস বলেন, ‘আমি খবরটা দেখে হেসেছিলাম। আমি এ রকম অনেক দেখেছি, আমি জানি এটা কখনোই হবে না।’
যুক্তরাজ্য অঙ্গীকার করেছিল তারা দেবে ১০ কোটি টিকা, এখন পর্যন্ত তারা ৯০ লাখেরও কম দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছিলেন, তিনি ৫৮ কোটি টিকা দান করবেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত দিয়েছে ১৪ কোটি। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২৫ কোটি টিকা দেওয়ার কথা বললেও এখন পর্যন্ত সরবরাহ করেছে তার মাত্র ৮ শতাংশ।
ইরানের মতো অনেক মধ্য আয়ের দেশ কোভ্যাক্স থেকে টিকা কিনেছে— যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমর্থিত একটি উদ্যোগ। কোভ্যাক্স মধ্য আয়ের দেশগুলোর কাছে কম দামে টিকা বিক্রি করবে এবং দরিদ্র দেশগুলোকে বিনামূল্যে দান হিসেবে দেবে; এটাই ছিল পরিকল্পনা।
২০২১ সালে কোভ্যাক্সের পরিকল্পনা ছিল ২০০ কোটি টিকা সরবরাহ করা, যা আসার কথা ভারত থেকে। কিন্তু সেখানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মারাত্মক চেহারা নেওয়ার পর ভারত সরকার টিকা রপ্তানি নিষিদ্ধ করে।
টিকা সরবরাহে এই গুরুতর বিঘ্নের পর কোভ্যাক্স মূলত ধনী দেশগুলোর দানের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু সরবরাহের গতি অত্যন্ত ধীর। কোভ্যাক্সের টিকা পাওয়া কিছু দেশ এখনও তাদের জনসংখ্যার ২ শতাংশকেও টিকা দিতে পারেনি।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, পৃথিবীতে যত কোভিড টিকা উৎপাদিত হয়েছে, তার ৭৫ শতাংশই গেছে বিশ্বের মাত্র ১০টি দেশে। ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট বলছে, এখন পর্যন্ত উৎপাদিত ভ্যাকসিনের অর্ধেকই গেছে পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশের কাছে।
কোভ্যাক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওরেলিয়া এনগুয়েন বলছেন, বর্তমানে খুব কম পরিমাণে টিকা শেয়ার হচ্ছে এবং তাদের যে সময় সীমা অর্থাৎ এক্সপায়ারি ডেটের মধ্যে ব্যবহার করতে হবে; সেই সময়সীমাটাও সংক্ষিপ্ত। এ কারণে টিকাগুলো একটা দেশে পাঠানোর কাজটা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এয়ারফিনিটি নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, এটা সারা বিশ্বের সরবরাহ সমস্যা নয়। ধনী দেশগুলো তাদের হাতে অতিরিক্ত টিকা মজুত করে রাখছে। টিকা উৎপাদনকারীরা এখন প্রতিমাসে দেড়শ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করছে এবং এ বছরের শেষ নাগাদ ১ হাজার ১০০ কোটি টিকা উৎপাদিত হবে।
এয়ারফিনিটির গবেষক ড. ম্যাট লিনলি বলছেন, তারা বিপুল পরিমাণ টিকা উৎপাদন করছে এবং গত তিন-চার মাসে উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর হাতে ১২০ কোটি ডোজ টিকা থাকবে, যা বুস্টার টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও আসলে দরকার হবে না।
ড. লিনলি বলছেন, এই টিকার প্রায় এক পঞ্চমাংশ—২৪ কোটি ১০ লাখ টিকা এখন ফেলে দেওয়ার ঝুঁকির মুখে পড়েছে। যদি না তাদের অতি শিগগিরই অন্য দেশগুলোকে দান করা হয়। এমন সম্ভাবনা আছে যে দরিদ্র দেশগুলো এসব টিকা গ্রহণ করবে না— যদি না এগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগে অন্তত দুই মাস সময় থাকে।
তিনি বলেছেন, ধনী দেশগুলো লোভের কারণে এত টিকা কিনে রেখেছিল এটা আমি মনে করি না। আসলে কোন টিকায় কাজ হবে তা তখন তারা জানতো না, ফলে তারা কয়েক রকম টিকা কিনতে বাধ্য হয়েছিল।
তবে এয়ারফিনিটি বলছে, এখন টিকা উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি যে রকম— তাতে অতিরিক্ত টিকার মজুত করে রাখার কোনও দারকার নেই। বরং তারা সেই অতিরিক্ত টিকা অন্য দেশকে দান করে দিতে পারে।
ধনী দেশগুলো তাদের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি টিকার মজুদ গড়ে তুলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) করোনার তিন বিলিয়ন বা জনপ্রতি ৬ দশমিক ৬ ডোজ টিকা সুরক্ষিত রেখেছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা জনপ্রতি ৫ ডোজ টিকা মজুদ করেছে। কানাডা ৪৫০ মিলিয়ন ডোজ টিকা সংগ্রহ করেছে; যা ৩৮ মিলিয়ন মানুষের জন্য জনপ্রতি ১২ ডোজ। যুক্তরাজ্য ৫০০ মিলিয়নেরও বেশি ডোজ টিকা মজুদ করেছে, যা জনপ্রতি ৮ ডোজ এবং অস্ট্রেলিয়া ১৭০ মিলিয়ন ডোজ টিকা সংগ্রহ করেছে ২৫ মিলিয়ন মানুষের জন্য, যা জনপ্রতি ৭ ডোজ।
প্রধানত প্রাপ্তবয়স্কদের টিকা দেয়ার বিবেচনায় ধনী দেশগুলোর জনপ্রতি টিকা সংগ্রহ করার প্রকৃত অনুপাতগুলো আরো অশোভনীয়। ইউনিসেফের মতে, বেশির ভাগ উচ্চ আয়ের দেশ তাদের প্রয়োজনের তুলনায় কমপক্ষে ৩৫০ শতাংশ বেশি ডোজ টিকার মজুদ গড়ে তুলেছে। অন্যদিকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে টিকা সরবরাহের বর্তমান চুক্তিগুলোর সর্বাধিক হিসাবে তাদের জনসংখ্যার মাত্র অর্ধেক অংশকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে পারবে কেবল ২০২৩-এর শেষের দিকে।
বিশ্বের শীর্ষ ধনী দেশগুলোর জোট জি৭-এর পক্ষ থেকে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ১ বিলিয়ন ডোজ টিকা বিতরণের প্রতিশ্রুতিসংক্রান্ত খবরটি প্রয়োজনীয় ১১ বিলিয়ন ডোজের তুলনায় অনেক কম। আসল সংখ্যা ৮৭০ মিলিয়ন ডোজ; কারণ ১৩০ মিলিয়ন ডোজ আগেই কোভ্যাক্স প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। কোভ্যাক্স ন্যায়সংগত টিকার অভিগমন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তাছাড়া এ বছরের শেষ অবধি প্রতিশ্রুত টিকা সরবরাহ শুরু হবে না। অর্থাৎ ধনী দেশগুলোর টিকা কার্যক্রম বেশির ভাগ সম্পন্ন হওয়ার পরেই এ টিকাগুলো গরিব ও অনুন্নত দেশে পাঠানো হবে। তথ্যানুসারে বেশির ভাগ দেশ প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত টিকার ক্রয়াদেশ দিয়েছে। এক্ষেত্রে স্পষ্টতই উন্মোচিত হয়েছে জি৭-এর আসল রূপ। তাদের কোনো গুরুতর পরিকল্পনা নেই, বিশ্বকে টিকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি তো অনেক দূরের ব্যাপার।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে টিকাদান কার্যক্রমের অসমতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো।
ইআইইউ পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে জনসংখ্যার ৬০ শতাংশকে টিকা দিতে ব্যর্থ হওয়া দেশগুলো ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার হারাবে।
ইআইইউর বৈশ্বিক পূর্বাভাসবিষয়ক পরিচালক অ্যাগাথ ডিমারিস বলেন, এ ক্ষতির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই বহন করবে উদীয়মান অর্থনীতিগুলো। এ পরিস্থিতি উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে উদীয়মান অর্থনীতির ব্যবধানকে আরো বিস্তৃত করবে।
ইআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে টিকার উৎপাদন ক্ষমতা, কাঁচামালের অভাব, পরিবহন ও সংরক্ষণে জটিলতা এবং টিকা নিতে অবিশ্বাসের কারণে এমন বৈষম্য আরো বেড়েছে। অনেক উন্নয়নশীল দেশ টিকার ব্যয় বহন করতে সক্ষম নয়। এক্ষেত্রে দেশগুলো ধনী দেশের অনুদানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যদিও বৈশ্বিক উদ্যোগ দেশগুলোর চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে টিকা সরবরাহ করতে পারছে না।
ইআইইউর ডিমারিস এক বিবৃতিতে বলেন, টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে এমন বৈষম্য দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতার উদীয়মান অর্থনীতিগুলোকে টিকা পাঠানোর উদ্যোগ কোভ্যাক্স প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। উদার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ধনী দেশগুলোর অনুদান প্রয়োজনীয়তার মাত্র ক্ষুদ্র একটি ভগ্নাংশ পূরণ করতে পেরেছে।
বিভিন্ন দেশে মহামারীর প্রথম ধাক্কার পর ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছে তার প্রভাবে বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারক এবং রাজনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মনে করছেন, মহামারী থেমে গেলে অগ্রসর অর্থনীতির দেশগুলোতে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে অবশ্য কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে দীর্ঘদিন। একদিকে মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে প্রবৃদ্ধি হুমকির মুখে পড়বে। অনিয়মিত পণ্য সরবরাহ এবং বাড়িভাড়া বৃদ্ধিও দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে। তাই টিকার বৈষম্য দ্রুত কমিয়ে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০২
আপনার মতামত জানানঃ