আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর বাংলাদেশের পানিসীমা বৃদ্ধি পেয়েছে আরও ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার। পূর্ণ অধিকারে থাকা বিশাল বিস্তৃত এ পানিসীমা বাংলাদেশের জন্য অরক্ষিত না হলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এখনো পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এ সুযোগে প্রতিবছর ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের পানিসীমায় ঢুকে লাখ লাখ টন মাছ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। মাছ ধরায় তারা ব্যবহার করছে দ্রুতগামী ট্রলার,অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর যন্ত্রপাতি। পক্ষান্তরে মান্ধাতা আমলের ইঞ্জিন চালিত নৌকা ও ট্রলার নিয়ে দেশীয় জেলেরা তাদের সঙ্গে কোনভাবেই পেরে উঠছে না।
নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশের জলসীমায় পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ায় গভীর সমুদ্রে ভারতীয় জেলেদের অবাধ বিচারণ চলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি ইলিশ মৌসুমেও ‘বেপরোয়াভাবে ভারতীয় জেলেরা মাছ লুট করছে’ বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশি জেলেরা বলছেন, তাদের (ভারতীয় জেলে) কারণে দেশি জেলেদের মাছ শিকার ব্যাহত হচ্ছে।
সার্বিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে মোংলা উপজেলা মৎস্য সমিতির সভাপতি বিদ্যুৎ মন্ডল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভারতীয় জেলেরা প্রতিনিয়ত আমাদের মাছ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। প্রজনন মৌসুমে বাংলাদেশে যখন মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, ভারতে তখন এ নিষেধাজ্ঞা থাকে না। ফলে সহজেই ওরা এসে মাছ ধরে নিয়ে যায়। একই সময় মাছ ধরতে না পেরে আমাদের জেলেরা অর্ধাহারে অনাহারে থাকে।’
বিদ্যুৎ মন্ডলের দাবি, ভরা মৌসুমেও ইলিশ না পেয়ে আমাদের হাজার হাজার জেলে খালি হাতে ফিরছে। কারণ তার আগেই ভারতীয় জেলেরা ইলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
‘ভারতীয় জেলেরা প্রতিনিয়ত আমাদের মাছ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। প্রজনন মৌসুমে বাংলাদেশে যখন মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, ভারতে তখন এ নিষেধাজ্ঞা থাকে না। ফলে সহজেই ওরা এসে মাছ ধরে নিয়ে যায়। একই সময় মাছ ধরতে না পেরে আমাদের জেলেরা অর্ধাহারে অনাহারে থাকে।’
জেলেদের দাবির সত্যতাও মিলছে এই মৌসুমে ভারতীয় জেলে আটক হওয়ার খবরে। সর্বশেষ গত শুক্রবার (৩ সেপ্টম্বর) অবৈধভাবে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ শিকারের সময় বিপুল পরিমাণ ইলিশ ও সামুদ্রিক মাছসহ ১৩ ভারতীয় জেলেকে আটক করে কোস্টগার্ড। এর আগে গত ৮ আগস্ট একই অপরাধে আরও ১৩ জন, ২৯ জানুয়ারি ২৮ জন ও গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ১৬ জন, ২ ডিসেম্বর ১৭ জন জেলে নৌ বাহিনীর হাতে আটক হয়। প্রতিবছরই এ ঘটনা ঘটে চলেছে।
এদিকে আটক ভারতীয় জেলেদের সমুদ্রসীমা লঙ্ঘনের অপরাধে ১৯৮৩ সালের সমুদ্রসীমা আইনের ২২ ধারায় মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয়।
বাংলাদেশের পানিসীমা রক্ষার দায়িত্বে রয়েছে কোস্টগার্ড। কোস্টগার্ডের অফিসিয়াল ওয়েব পেজের সর্বশেষ তথ্যমতে টহল এবং অন্যান্য কাজের জন্য রয়েছে ১৮টি অত্যাধুনিক বোট ও ২৫টি বিভিন্ন ক্লাসের জাহাজ। চোরাচালান, বনজ সম্পদ রক্ষা, বন্দরগুলোর নিরাপত্তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে অভিযানের পাশাপাশি অবৈধ মৎস্য আহরণ বিরোধী অভিযান কোস্টগার্ড পরিচালনা করে। এক্ষেত্রে বিশাল সমুদ্র সীমা রক্ষায় এ বাহিনীর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কোস্টগার্ড নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন মোংলা সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি মৌসুমে ৮ টি অভিযানে ১১টি ফিশিং ট্রলারসহ ১২৮ জন ভারতীয় জেলে নৌ-বাহিনী ও কোস্টগার্ডের হাতে আটক হয়। এর মধ্যে চলতি বছরে দেশীয় জলসীমায় মাছ ধরার অপরাধে ৩ দফায় ৪টি ফিসিং ট্রলারসহ ৫৪ জন ভারতীয় জেলেকে আটক করে কোস্টগার্ডের টহল জাহাজ বিসিজিএস সোনার বাংলা ও বিসিজিএস স্বাধীন বাংলা।
অভিযোগ আছে, ভারতীয় জেলেরা ইচ্ছে করেই বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে প্রতিনিয়ত মাছ শিকার করে। তারা এসময় উন্নত মানের ফিশিং বোট নিয়ে মাছ শিকারের সময় উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বাইনোকুলার দিয়ে ট্রলারে বসে নৌ বাহিনী ও কোস্টগার্ডের তৎপরতায় নজর রাখে। এসব বাহিনীর তৎপরতা দেখলেই দ্রুত নিজেদের জলসীমায় পালিয়ে যায়।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা (মোংলা সদর দফতর) লেফটেন্যান্ট কমান্ডার শেখ মেজবাহ উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশীয় জলসীমায় ভিনদেশি জেলেদের প্রতিহত করতে নৌ বাহিনীর পাশাপাশি কোস্টগার্ড কাজ করছে। বিদেশি জেলেরা যাতে দেশীয় সীমানায় ঢুকতে না পারে সে বিষয়ে তাদের গতিবিধি মনিটরিংয়ের আওতায় এনে আমরা আরও কঠোর হচ্ছি।’
বলেন, মৎস্য সম্পদের ভান্ডার বঙ্গোপসাগরের মাছ বিদেশীদের দ্বারা লুট হচ্ছে। ভারতীয় জেলেরা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে মৎস্য আহরণ করছে। ওই কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশীয় জেলেরা। তাই ভিনদেশী জেলেদের আগ্রাসন বন্ধে সরকারের হস্তক্ষেপ চান তারা।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘যেভাবে বিদেশি জেলেরা মাছ শিকার করছে, তাতে এদেশের মৎস্য সম্পদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে যারা আটক হচ্ছে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া দরকার।’
তাছাড়া দেশের মৎস্য সম্পদ রক্ষায় বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা ব্যাবস্থা আরও জোরদারের দাবি জানান তারা।
তারা বলেন, ‘সাগর যদি রক্ষা করা না যায়, তাহলে সাগর জয়ের সুফল বাংলাদেশ পাবে না। মৎস্য সম্পদ রক্ষায় সরকারের নিষেধাজ্ঞা শেষে শুটকী আহরণে সমুদ্রে অক্টোবর থেকে অস্থায়ীভাবে ৭ মাস যাবত দুবলার চর, আলোর কোলসহ চরাঞ্চলে বসবাস করবে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা জেলেরা। পাশাপাশি সুন্দরবনের প্রাণ পশুর নদী এবং সংকটাপন্ন সুন্দরবন রক্ষারও দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে প্রকৃত জেলেদের চিহ্নিত করে ভাতার ব্যবস্থা ও দুবলায় মৎস্য আহরণে থাকা জেলেদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতাল নির্মাণের দাবি জানানো হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৯
আপনার মতামত জানানঃ