পাকিস্তানে শিক্ষকদের জন্য নতুন ‘ড্রেস কোড’ ঘোষণা করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এখন থেকে সেখানকার সরকারি স্কুল-কলেজগুলোতে নারী শিক্ষকদের ইচ্ছা মত পোশাক পরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নারী শিক্ষকদের সালোয়ার কামিজ, ট্রাউজার, পোশাকের সঙ্গে ওড়না বা শাল পরতে উৎসাহিত করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে পুরুষ শিক্ষকদের জিন্স ও টি-শার্ট পরার ওপরও।
সম্প্রতি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষা অধিদপ্তর (এফডিই) দেশটির চার শতাধিক স্কুল-কলেজে চিঠি পাঠিয়ে এ নির্দেশনা দিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রিন্সিপালরা যেন নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত চুল কাটা, দাঁড়ি ছাটা, নখ কাটা, সুগন্ধি ব্যবহারসহ ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলো নিশ্চিত করেন।
পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম ডন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নতুন নির্দেশিকায় বলা হয়েছে দেশটির স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা জিনস, টি-শার্ট পরে পড়াতে পারবেন না। শিক্ষিকারা স্কুল-কলেজে পাঠদানের সময় টাইট পোশাক পরতে পারবেন না। এমনকি স্কুল-কলেজের কোনো অনুষ্ঠানেও এ ধরনের পোশাক পরা যাবে না।
ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব স্কুল, কলেজের প্রধান শিক্ষকদের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠিয়েছে দেশটির শিক্ষা অধিদপ্তর। নতুন নির্দেশিকায় পোশাকের পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আচরণবিধিসংক্রান্ত বিভিন্ন নিয়ম জারি করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রত্যেক শিক্ষককে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। পুরুষ শিক্ষকদের নিয়মিত চুল, দাড়ি ছাঁটতে হবে।
শিক্ষক-শিক্ষিকানির্বিশেষে সবাইকে নিয়মিত গোসল করতে হবে, নখ কাটতে হবে। স্কুল-কলেজে আসার সময় ডিওডোরেন্ট বা পারফিউম মাখতে হবে। নির্দেশিকায় আরও বলা হয়েছে, পড়ানোর সময় শিক্ষকদের টিচিং গাউন পরতে হবে। গবেষণার সময় ল্যাব কোট পরতে হবে।
নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, শিক্ষিকাদের সালোয়ার, কামিজ, ট্রাউজার, শার্টের সঙ্গে ওড়না বা চাদর পরতে হবে। শিক্ষিকারা চাইলে স্কার্ফ বা হিজাব পরতে পারবেন। শিক্ষক-শিক্ষিকা সবাইকেই ফর্মাল জুতা পরতে হবে। স্যান্ডেল পরে স্কুল-কলেজে আসা যাবে না।
শিক্ষকরা কেবল পাম্প সু বা লোফারের মতো সাধারণ জুতা পরে স্কুল-কলেজে আসতে পারবেন। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে পাঠদানের সুবিধার্থে স্নিকার ও স্যান্ডেল পরা যাবে। তবে কোনোভাবেই স্লিপার পরে আসা যাবে না।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, পাকিস্তানে বহু বছর ধরেই নারীরা বৈষম্যের শিকার। অর্থনৈতিক, সামাজিক, নাগরিক, রাজনৈতিক— এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যেখানে অবহেলিত নন দেশটির নারীরা। নিজের পছন্দে বিয়ে করা বা বাইরে কাজে বের হওয়ার মতো বিষয়গুলোতে প্রতিনিয়ত বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের।
পাকিস্তানে নারীদের বর্তমান আইনি অবস্থান রূপায়িত হয়েছিল মূলত জিয়া-উল-হকের সামরিক শাসনামলে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৭ সালের সেই সময়টিতে একাধিক দমনমূলক আইন পাস হয়, যাতে সরকারি-বেসরকারি খাতে নারীদের প্রতি বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
এসব আইনের মাধ্যমে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হয়ে ওঠার পূর্বপ্রতিশ্রুতি থেকে অনেকটা দূরে সরে যায় পাকিস্তান। সেখানে হুদুদ অধ্যাদেশ জারি হয়, যাতে পারিবারিক আইন এবং যৌনতা বিষয় ‘ইসলামী আইনের’ বেশ কিছু রক্ষণশীল নীতি ব্যবহার করা হয়। তবে ধর্ষণ, ‘অনার কিলিং’ (পারিবারিক সম্মান রক্ষার অজুহাতে হত্যা), অ্যাসিড নিক্ষেপ, পারিবারিক সহিংসতা, জোরপূর্বক বিয়ের মতো বিষয়গুলো উপেক্ষিতই থেকে যায়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, পাকিস্তানে প্রতিবছর অন্তত এক হাজার অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে। তবে এর প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই এধরনের হত্যার খবর প্রকাশ্যে আসে না অথবা পরিবার থেকে সেগুলোকে আত্মহত্যা বা স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে তুলে ধরা হয়। ২০১৬ সালের একটি বিলের মাধ্যমে অনার কিলিংয়ের সাজা যাবজ্জীবন করা হলেও তাতে পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
এদিকে পাকিস্তানে নারীর বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার মধ্যে অল্প কয়েকটিই কেবল দেশটির মিডিয়া কাভারেজ পাচ্ছে বলে পাকিস্তান ভিত্তিক আইনজীবীদের একটি দল জানিয়েছে।
টেকসই সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার (এসএসডিও) একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সেখানে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে কেবল পাঞ্জাব প্রদেশেই ৬ হাজার ৭৫৪ জন নারী কিডন্যাপ হয়েছেন। এছাড়া ১ হাজার ৮৯০ জন ধর্ষণের শিকার এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ৩ হাজার ৭২১টি রেকর্ড করা হয়েছে।
এসএসডিও’র প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, পাঞ্জাব প্রদেশে আর ৭৫২টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। অন্যদিকে, রাজধানী ইসলামাবাদে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৪ জন নারী। কিন্তু মিডিয়ায় কেবল ২৭টি ঘটনা কাভারেজ পেয়েছে।
পাঞ্জাব প্রদেশে ধর্ষণ, নারী সহিংসতা, সাংসারিক নির্যাতন, কিডন্যাপ এবং শিশু নির্যাতনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি রেকর্ড করা হয়েছে লাহোর জেলায়।
এসএসডিও’র পরিচালক শাহিদ জাতোই বলেন, মিডিয়ায় এসব ঘটনার কম কাভারেজ পাওয়া আরও অশনি সংকেত দিচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৭
আপনার মতামত জানানঃ