করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক, মৃত্যু ভয়, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততার কারণে বাড়ছে মানসিক সংকট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, আত্নীয় স্বজন বন্ধুদের সান্নিধ্য না পাওয়ায় বাড়ছে একাকিত্ব। অর্থাৎ হীনমন্যতা, একাকিত্ব থেকেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আত্মহত্যাকে সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নেয়।
আত্মহত্যা একটা সাময়িক সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান। সমস্যাটা হয়তো সাময়িক এবং এর সমাধানও ভবিষ্যতে বিদ্যমান। তবে পরাজিত সৈনিকের ন্যায় সমস্যার মোকাবেলা না করে কাপুরুষের ন্যায় আত্মহত্যার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান প্রজন্মের মাঝে আত্মহত্যা একটি মহামারির ন্যায় দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২০ সালে ১১ হাজার ২৫৯ জন আত্মহত্যা করে। ব্যুরোর এর আগের বছরের হিসাবে অর্থাৎ ২০১৯ সালে ৯ হাজার ৩১০ জন আত্মহত্যা করে। সরকারের হিসাবে করোনাকালে ১৭ দশমিক ৩১ শতাংশ আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে ।
তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা যায়, করোনাকালে এক বছরে দেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন। ২০১৯ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের সঙ্গে তুলনা করে সংগঠনটি জানায়, করোনাকালে ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে।
চিন্তা রিসার্চ বাংলাদেশ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের গবেষণায় দেখা যায়, করোনা ভীতি এবং সামাজিক অবস্থা—এই দুই কারণে বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। এই যৌথ গবেষণা কাজের অন্যতম গবেষক মোহাম্মদ এ মামুন বলেন, তাদের গবেষণায় দেখা যায় করোনার শুরুর সময় করোনাজনিত আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ে ৫ শতাংশ। এপ্রিল মাসে অর্থাৎ একমাস পরে এই ঝুঁকি বাড়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। এপ্রিল-মে মাসে ঝুঁকি বাড়ে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ এবং জুলাইয়ে গিয়ে আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ে ১৯ শতাংশ। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ-এ আত্মহত্যার প্রবণতা কিছুটা কমে আসে।
ব্রাইটার টুমরো ফাউন্ডেশন (বিটিএফ) জানায়, বিশ্বে ও আমাদের দেশে আত্মহত্যা ও আত্মহত্যা প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে আত্মহত্যায়। ১৪ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ আত্মহত্যা। কিন্তু প্রতিরোধে তেমন কোনো সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।
এদিকে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে মোট মৃত্যু হয়েছিল সাত হাজার ৫৫৯ জনের ।
করোনা সংক্রমণে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (বুধবার সকাল ৮টা থেকে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) দেশে আরও ৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ৫৮৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সব মিলিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১৫ লাখ ২৪ হাজার ৮৯০। মোট মৃত্যু হয়েছে ২৬ হাজার ৭৯৪ জনের।
নারীদের আত্মহত্যা বেশি
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানুষের প্রায় ৫ শতাংশ একবারের জন্য হলেও আত্মহত্যা করার চিন্তা করেছেন। ১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ একবারের জন্য হলেও পরিকল্পনা বা চেষ্টা করেছেন। সেই গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা পুরুষের তুলনায় প্রায় তিন গুণ। আবার গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে আত্মহত্যার চিন্তা করার হার দ্বিগুণ।
গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে পুরুষের চেয়ে বেশি নারী আত্মহত্যা করেছেন। নারীদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যাটা ৫৭ শতাংশ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশ। মোট আত্মহত্যার ঘটনা ১৪ হাজার ৪৩৬টি। এর মধ্যে নারীর আত্মহত্যার ঘটনা আট হাজার ২২৮টি এবং পুরুষের আত্মহত্যার ঘটনা ছয় হাজার ২০৮টি।
করোনাকালে আত্মহত্যার কারণ উল্লেখ করে বলা হয়, পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩৫ শতাংশ। এর বাইরে ২৪ শতাংশ সম্পর্কে টানাপোড়েনের কারণে এবং অজানা কারণে ৩২ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। আর্থিক ও লেখাপড়ার কারণে আত্মহত্যা করেছেন যথাক্রমে ৪ ও ১ শতাংশ।
বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস আজ
‘কর্মের মাধ্যমে আশা তৈরি করো— এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আজ ১০ সেপ্টেম্বর, বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে ও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে ২০০৩ সাল থেকে প্রতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর দিনটিকে বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থার সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্য ফেডারেশন একযোগে দিবসটি পালনে কাজ করছে। ২০১১ সালে বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশ এ দিবসটি পালন করে।
আত্মহত্যা একটা সাময়িক সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান। সমস্যাটা হয়তো সাময়িক এবং এর সমাধানও ভবিষ্যতে বিদ্যমান। তবে পরাজিত সৈনিকের ন্যায় সমস্যার মোকাবেলা না করে কাপুরুষের ন্যায় আত্মহত্যার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান প্রজন্মের মাঝে আত্মহত্যা একটি মহামারির ন্যায় দেখা দিয়েছে।
২০১৪ সালে ডব্লিউএইচও প্রকাশিত মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিশ্বজুড়ে নিম্নআয়ের কোনো দেশেই আত্মহত্যা প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট কোনো কৌশল বা কর্মপন্থা নেই। তবে মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ১০ শতাংশ এবং উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে এ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে।
বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালন উপলক্ষে শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) রাজধানীতে র্যালির আয়োজন করেছে হিল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন। সকাল ৯টায় রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকা থেকে এ র্যালি শুরু হয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ, সংসদ ভবন এলাকা ও আসাদ গেট এলাকা প্রদক্ষিণের কথা রয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র চত্বরে ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শদান দপ্তর এবং অ্যাডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের যৌথ উদ্যোগে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।
আন্তর্জাতিক এ দিবস ঘিরে অনলাইনভিত্তিক প্ল্যাটফর্মগুলোতেও থাকছে আত্মহত্যা প্রতিরোধবিষয়ক আলোচনা ও অনুষ্ঠান আয়োজন।
করোনায় বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা
করোনার কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে এসব প্রতিষ্ঠানের লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপের বিষয়। হতাশা, একাকিত্ব, মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। উদ্বেগ আর মানসিক চাপ ছাড়াও এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা। যেমন অতিরাগ, জেদ এবং একাকিত্ববোধে ভোগার মতো মানসিক অসুবিধা। এছাড়া অনেক শিক্ষার্থী ঝুঁকে পড়ছে মোবাইল ও ইন্টারনেটে। এতে করে অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তি তৈরি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। মোবাইল না পেয়ে রাগে কিংবা ক্ষোভের কারণে আত্মহত্যার ঘটনার সংখ্যাও বাড়ছে দেশে।
করোনার কারণে স্কুল-কলেজের পাশাপাশি বন্ধ আছে বিনোদনের প্রায় সব ব্যবস্থা, নেই ঘুরতে যাওয়ার মতো অবস্থা। দীর্ঘদিন ঘরবন্দি অবস্থা শিশুদের মানসিক বিকাশে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনোবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। পড়ালেখা, ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কায় ভুগছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা, যা তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
করোনার আঘাতে বিপর্যস্ত মানুষ। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা। দিন দিন তারা আর্থিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় জেঁকে বসেছে হতাশা। শিক্ষা, চাকরি ও আর্থিকসহ সব ক্ষেত্রে বিরাজ করছে অনিশ্চয়তা। অভাব ঘরে হানা দেয়ায় কেউ কেউ বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যার পথ। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ যখন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন তুচ্ছ কারণেও আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়েন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, আত্মহত্যা করার ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। ব্যক্তিবিশেষে ক্ষেত্রগুলো ভিন্ন হয়ে থাকে। নিজের স্বার্থে আঘাত লাগা, চাহিদার সঙ্গে প্রাপ্তির ব্যবধান, অসহায়ত্ব, কর্মহীনতা, নৈতিক মূল্যবোধ একেবারে ফুরিয়ে যাওয়া, অর্থসংকট ও চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে না নিতে পারাসহ বেশ কয়েকটি কারণে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। বিশেষ করে করোনার ঘরবন্দি সময়ে মানসিক অস্থিরতা এর জন্য অন্যতম দায়ী।
তারা বলেন, করোনার সময়ে যেভাবে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে গেছে তা সত্যিই শঙ্কিত করে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। পরিবারে জ্যেষ্ঠদের খেয়াল রাখতে হবে, তাদের ছেলে-মেয়ে কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে। না হলে যে কেউ ভুল পথে পা বাড়াতে পারে। কারণ আত্মহত্যা করার পেছনে পরিবার, সমাজ ও দেশেরও দায় রয়েছে। মানুষ কেন আত্মহত্যা করে, তা নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা হওয়া দরকার।
আত্মহত্যা ঠেকানোর জন্য পরিবার এবং সমাজকে প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এক্ষেত্রে পরিবারগুলোকে প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে, তবে পরিবারকেও নিজেদের আচরণ এবং প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
তারা কিছু পদক্ষেপের কথা বলেছেন— পরিবারের ছোটদের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক বাড়াতে হবে, তাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সন্তানদের খেলাধুলা করা এবং সামাজিক মেলামেশা করার সুযোগ বাড়িয়ে দিতে হবে। সন্তানকে চাপ মোকাবেলা করতে শেখাতে হবে, পড়াশোনা বা খেলাধুলা নিয়ে সন্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ না করা। ব্যর্থতা মেনে নেয়া নিজেরাও শিখতে হবে, বাচ্চাকেও শেখাতে হবে। ব্যর্থতা জীবনের অংশ এটা বুঝতে হবে। তিরস্কার করা বা তাদের মর্যাদাহানিকর কিছু না বলা, মনে আঘাত দিয়ে বা সবসময় সমালোচনা না করা, সমবয়সী অন্যদের সঙ্গে তুলনা না করা। আত্মীয়, বন্ধু এবং আশেপাশের পরিবারসমূহকেও এ বিষয়ে সচেতন করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৮
আপনার মতামত জানানঃ