মানুষের শরীরের চামড়ার রঙের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র-সমাজে যে বৈষম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থা সেটার সূত্রপাত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দখল ও আধিপত্যের মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী এই দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই গভীরে শিকড় গেড়েছে যে, এর বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই সত্ত্বেও একবিংশ শতাব্দীতেও এর অবসান হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শ্বেতকায়ই কালো মানুষদের তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে এখনও প্রস্তুত নয়।
এবার এক প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে দেশটির অন্ধকার এই দিক আবারও আলোর মুখ দেখলো। যুক্তরাষ্ট্রে গত ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হেইট ক্রাইম বা বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধ হয়েছে ২০২০ সালে। এই অপরাধের শিকার হয়েছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ। জাতিগত, জেন্ডার, ধর্মবিশ্বাসের পার্থক্যসহ বিভিন্ন কারণে দেশটিতে এ ধরনের ঘটনা সংগঠিত হয়েছে।
চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে এ খবর জানিয়েছে বিবিসি।
সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে বিশেষভাবে এশীয় বংশোদ্ভূত ও কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের ওপর বিদ্বেষপ্রসূত হামলা বেশি ছিল। জানা যায়, ২০১৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধ ঊর্ধ্বমুখী।
২০২০ সালে এফবিআই এ ধরনের সাত হাজার সাতশ’র বেশি অপরাধ নথিভুক্ত করেছে। ওই বছর এ ধরনের সাত হাজার ৭৮৩টি অভিযোগ পেয়েছিল সংস্থাটি। ২০০৮ সালের পর এ সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সূত্র মতে, ছয় হাজার চারশ’র বেশি হামলাকারীর ৫৫ শতাংশই শ্বেতাঙ্গ।
যদিও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন যেহেতু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো হেইট ক্রাইমের তথ্য এফবিআইকে জমা দিতে বাধ্য নয়, তাই এ ধরনের অপরাধের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।
গত বছর করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে মূলত এশীয় বংশোদ্ভূতদের বিরুদ্ধে সংঘটিত ২৭৪টি বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের তথ্য পেয়েছে এফবিআই। আইনজীবীরা বলছেন, ভাইরাসের উৎস নিয়ে বিতর্ক থেকে এশীয় বংশোদ্ভূতদের প্রতি ক্ষোভের প্রকাশ বেড়েছে।
অন্যদিকে ২০১৯ সালের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গবিদ্বেষী ঘটনা খুব বেশি না ঘটলেও সবচেয়ে ভুক্তভোগী এ জনগোষ্ঠীর সদস্যরাই। গত বছর আফ্রিকান আমেরিকানদের বিরুদ্ধে দুই হাজার ৭৫৫টি হেইট ক্রাইম নথিবদ্ধ করেছে এফবিআই।
এফবিআই জানিয়েছে, বিদ্বেষপ্রসূত হামলার ৬২ শতাংশ ভুক্তভোগীই জাতিবিদ্বেষের শিকার। ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে ১৩ শতাংশ এবং যৌন প্রবণতার কারণে ২০ শতাংশ মানুষ হেইট ক্রাইমের শিকার।
যুক্তরাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থাও হেইট ক্রাইমের পৃষ্ঠপোষকতা করে। আমেরিকার কালো মানুষদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ, অথচ কারাগারে মোট বন্দির ৪০ শতাংশই হলো এ দেশের কালো মানুষ। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ব্রেনন সেন্টার ফর জাস্টিস-এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০-৩৪ বছর বয়সী এমন প্রতি নয়জন আফ্রিকান-আমেরিকানের একজন এখন জেলে।
আরেকটি গবেষণা বলছে, প্রতি তিনজন আফ্রিকান-আমেরিকানের মধ্যে অন্তত একজনকে জীবনে একবার হলেও জেলে যেতে হয়। যে অপরাধে এরা জেলে, একই অপরাধে সাদা বা বাদামি রঙের মানুষেরা সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়। আমেরিকায় কালোদের সামান্য অপরাধেই বড় সাজা পেতে দেখা যায়। সাদাদের ক্ষেত্রে বড় অপরাধেও তা হয় না।
এক গবেষণায় জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে নিহত হয়েছে ৭ হাজার ৬৬৬ জন। এই হতভাগ্যদের মধ্যে আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গই বেশি।
২০১০ সালে করা সমাজবিজ্ঞানী ইভলিন জে প্যাটারসনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কারাগারের বাইরে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিদের চেয়ে কারাগারে থাকা কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুহার কম। এর অর্থ হলো, বাইরের চেয়ে কারাগারে ভালো চিকিৎসাসেবা পায় কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিরা।
আদতে বর্ণবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় দেশটির চিকিৎসা ক্ষেত্রেও। যুক্তরাষ্ট্রে অন্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের মধ্যে করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেশি।
উদাহরণস্বরূপ, উইসকনসিন অঙ্গরাষ্ট্রের মিলওয়াকি কাউন্টির ২৬ শতাংশ মানুষ কালো, কিন্তু এ কাউন্টিতে করোনায় মোট মৃত্যুর ৭৩ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। লুইজিয়ানায় ৩২ শতাংশ কালো মানুষের বসবাস, অথচ করোনায় মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ। শিকাগোতে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী ৩২ শতাংশ, আর করোনায় মৃত্যু হার ৬৭ শতাংশ। শিকাগোতে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুর হার ৬ গুণ বেশি। জর্জিয়ার ডাউঘারটি কাউন্টিতে করোনায় কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যু হার ৯০ শতাংশের বেশি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ