আবারও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে রক্ত ঝরলো বাংলাদেশির। লালমনিরহাট বুড়িমারী মাইয়ামরাঘাট সীমান্তে ভারতীয় চেংরাবান্ধা বিএসএফ’র গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। আজ রোববার (২৯ আগস্ট) ভোরে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত একজনের নাম ইউনুস (৩৩)। তিনি পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের কলাবাগান এলাকার বুলবুল হোসেনের ছেলে। নিহত আরেক যুবক নীলফামারীর সাগর চন্দ্র। তার বিষয়ে বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি।
বিজিবি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আজ রোববার ভোর রাতে বুড়িমারী সীমান্তের ৮৪৩ মেইন পিলার দিয়ে ভারতের চেংরাবান্ধায় চোরাইভাবে গরু আনতে যান ইউনুস ও সাগর চন্দ্র। এ সময় ভারতীয় চেংরাবান্ধা বিএসএফ সদস্যরা তাদের লক্ষ করে গুলি করে। বিএসএফ-এর গুলিতে নিহত দুজনের লাশ ভারতের অংশে পড়ে থাকে। খবর পেয়ে বুড়িমারী বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা ওই সীমান্তে গেলে বিএসএফ লাশ রেখে চলে যায়। খবর পেয়ে বুড়িমারী বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা ওই সীমান্তে গেলে বিএসএফ লাশ রেখে চলে যায়। পাটগ্রাম থানার অফিসার ইনচার্জ মো. ওমর ফারুক জানান, ভারতের অংশে দুজনের লাশ রয়েছে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে।
পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, নিহতদের লাশ ভারতের অভ্যন্তরে রয়েছে।
এর আগে গত ১৪ জুলাই লালমনিরহাটের আদিতমারী সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে সুবল চন্দ্র সাদ্দাম (৩৩) নামের এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হন। এ ঘটনায় আরো দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের মহিসতলী সীমান্তের মেইন পিলার ৯২০ এর সাব পিলার ৮ এর কাছে এ ঘটনা ঘটে। নিহত সাদ্দাম একই ইউনিয়নের ফলিমারী গ্রামের পেলকু চন্দ্রের ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, নিহত সুবল গরু পারাপারকারী রাখাল হিসেবে কাজ করতেন। তিনি ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের তালুক দুলালী এলাকার বাসিন্দা।
আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জানান, সুবলসহ কয়েকজন স্থানীয় বারঘড়িয়া সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় গরু ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় ভোরে গরু আনতে যায়। এসময় বিএসএফের কৈমারী ক্যাম্পের টহল দলের গুলিতে তার মৃত্যু হয়। অন্যরা পালিয়ে যায়। ভেলাবাড়ী ইউপির ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার রজব আলী বলেন, ঘটনার পর থেকে বিএসএফ বাংলাদেশ থেকে চার গজ দূরে ভারতের ভেতরে মরদেহটিকে ঘিরে রেখেছে।
বিজিবি জানায়, সুবল ভেলাবাড়ী দুলালী সীমান্ত দিয়ে ১০-১২ জনের একটি দলের সঙ্গে ভারতের হিজলতলা গ্রাম দিয়ে গরু আনতে যান। ভোরে সবাই মিলে গরু নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করলে বিএসএফ ৭৫ ব্যাটালিয়নের রানীনগর ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। এ সময় সবাই পালিয়ে আসে। তবে ঘটনাস্থালে সুবল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এছাড়া আরও দুজন গুলিবিদ্ধ হন। তাদের গোপনে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
তথ্য মতে, ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে সীমান্তে গুলিতে নিহত হয়েছে ৪২ জন বাংলাদেশি। আর নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে ৬ জন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে উন্নতি ঘটলেও তার প্রতিফলন দেখা যায়নি দুই দেশের সীমান্তে। সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুই দেশের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা হলেও তাতে সীমান্ত পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেনি। এমনকি সীমান্তে প্রানঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার ব্যাপারে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে ঐক্যমত্য থাকলেও তা প্রায়ই লঙ্ঘন হতে দেখা যায়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘সীমান্তের হত্যা কমবে না, সংখ্যাটাও নিচে নামবে না। কারণ, ভারতের বিএসএফকে আমি সবসময় ট্রিগার হাতেই দেখি। তারা গুলি করার জন্য প্রস্তুত থাকে। আগে গুলি করে, পরে কথা বলে।’
তিনি বলেন, ‘বিএসএফের বেশিরভাগ সদস্যই অবাঙালি। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তারা এখনো মনে করে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুধার্ত, বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশ। তাই তারা ভারতে যায়। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। বিষয়টি ভারতের পলিটিক্যাল লেভেল (রাজনৈতিকভাবে) থেকে বিএসএফকে সেভাবে বার্তা দেওয়া হয় না অথবা বিএসএফ তাদের কথা শোনে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার মতে, যদি ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চায়, তাহলে তাদের নিচের লেভেলে (বিএসএফ) অ্যাকশন নিতে হবে। তবে এ ধরনের অ্যাকশন তারা আগে কখনো নেয়নি। এমনকি ফেলানীর ঘটনায়ও কিছু হয়নি। পলিটিক্যাল লেভেল থেকে শক্ত বার্তা না দিলে সীমান্তে হত্যার কোনো সুরাহা হবে না। এ হত্যাকাণ্ড বাড়তে থাকলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব আরও প্রকট হবে’।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর আবু আহমেদ ফয়জুল কবির অনলাইনভিত্তিক এক দৈনিককে বলেন, ‘বিএসএফ দ্বারা হত্যার পর কোনো বাংলাদেশির কাছে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেছে— এমন কোনো নজির বা ঘটনা নেই। যারা মারা যান, তাদের শতভাগই নিরীহ (ইনোসেন্ট)। যেহেতু বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে কোনো অস্ত্র থাকে না সেক্ষেত্রে বিএসএফ সদস্যরা তাদের আটক করে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা নির্যাতন ও গুলি চাই না। এমনকি সীমান্তে ভারতের অনুপ্রবেশকারী নাগরিক থাকলে বিজিবি তাদের আটক করে ফিরিয়ে দেয়, হত্যার নজির নেই। অথচ আগ্নেয়াস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও বিএসএফ বাংলাদেশিদের হত্যা করছে। বিএসএফের উচিত বাংলাদেশ ও ভারতের ঐতিহ্যবাহী সম্পর্কের কথা বিবেচনায় নিয়ে নমনীয় আচরণ করা।’
এসডব্লিউ/ডব্লিউজেএ/১৮৩৩
আপনার মতামত জানানঃ