আজ ২৬ আগস্ট দিনাজপুরের ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডি দিবস। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী কয়লাখনি না করার দাবিতে ২০০৬ সালের এই দিনে বিক্ষোভ করা হয়। ঘেরাও করা হয় এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী অফিস। সে সময় তৎকালীন বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) ও পুলিশের গুলিতে কলেজছাত্র তরিকুল, আমিন ও সালেকিন নামের তিন যুবক প্রাণ হারান। আহত হন প্রায় দুই শতাধিক নারী-পুরুষ। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ অনেকেই এখনও পঙ্গুত্বের অসহণীয় যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন।
কিন্তু ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এই চুক্তি এখনও পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। বরং এখনও ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি হওয়ার পায়তারা চলছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
স্থানীয়রা জানান, ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট সকাল থেকেই ফুলবাড়ীর ঢাকা মোড়ে ফুলবাড়ী, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ ও পার্বতীপুর উপজেলার হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হতে থাকেন। দুপুর ২টার দিকে তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ও ফুলবাড়ী রক্ষা কমিটির নেতৃত্বে বিশাল প্রতিবাদ মিছিল নিমতলা মোড়ের দিকে এগুতে থাকে। এসময় পুলিশ বাধা দেয়।
পুলিশের বাধা পেয়ে বিশাল মিছিলটি ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। পুলিশ-বিডিআরের ব্যারিকেড ভেঙে মিছিলটি আগাতে থাকলে আন্দোলনকারীদের ওপর টিয়ার সেল, রাবার বুলেট ও নির্বিচারে গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলে নিহত হয় সুজাপুর চাঁদপাড়া গ্রামের মকলেছুর রহমানের ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তরিকুল ইসলাম (২০), বারকোনা গ্রামের আব্দুল হামিদের ছেলে আমিন (১৫) ও উত্তর সাহাবাজপুর গ্রামের সালেকিন (১৭)।
একই ঘটনায় দক্ষিণ সাহাবাজপুর গ্রামের প্রদীপ চন্দ্র, রতনপুর গ্রামের শ্রীমান বাস্কে, সুজাপুর গ্রামের বাবলু রায়সহ আহত হয় তিন শতাধিক মানুষ। এরপর ফুলবাড়ীবাসী ধর্মঘটের মাধ্যমে এলাকায় অচলাবস্থার সৃষ্টি করে।
এরপর ফুলবাড়ীর মানুষ গণআন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে ফুলবাড়ীর ওপর দিয়ে বাস, ট্রেন চলাচলসহ সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সারাদেশের সঙ্গে কয়েকদিন ফুলবাড়ীর যোগাযোগ বিছিন্ন থাকে। ফুলবাড়ীর মানুষের গণআন্দোলনের মুখে ৩০ আগস্ট তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রতিনিধি দল ফুলবাড়ীবাসীর সঙ্গে একটি বৈঠক করে ৬ দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তির ১৫ বছর পার হলেও বাস্তবায়ন হয়নি সে চুক্তি। সেই দিনের কথা মনে হলে আজও তাদের বুক ভয়ে কেঁপে উঠে। তারা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি চায় না। তারা ৬ দফা দাবির বাস্তবায়ন চায়।
আন্দোলনের নেতা বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু বলেন, ২০০৬ সালে এশিয়া এনার্জি কৃষি এলাকায়, বসতভিটা, মসজিদ-মন্দির ধ্বংস করে কয়লা উত্তোলনের পায়তারা করলে গণঅভ্যুত্থান হয়। ওই সময়ে ছয় দফা চুক্তি করা হলেও এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। কিছু কিছু দাবি হয়তো বাস্তবায়িত হয়েছে। এখনও এশিয়া এনর্জি তাদের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ফুলবাড়ী কোল প্রজেক্ট নামে লন্ডনে তারা শেয়ার মার্কেটে ব্যবসা করছে, আন্দোলনকারী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করছে। তাদের অফিস এখনও চালু রয়েছে, এবং নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ৬ দফা চুক্তির অন্যতম ছিল কৃষি জমি ধ্বংস করে কোথাও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি হবে না। ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি হলে অন্তত ৬৬৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা পানিশূন্য হবে। ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এশিয়া এনার্জিকে দেশ থেকে প্রত্যাহার করা হোক এই দাবি করছি।
এ ব্যাপারে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ফুলবাড়ী শাখার সদস্য ও আন্দোলনের অন্যতম নেতা নুরুজ্জামান বলেন, সেই সময়ের ৬ দফা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদের ওপর দেশের মানুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। তাই এই চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আমাদের এই আন্দোলন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, শুধুই সম্পদ রক্ষার আন্দোলন।
ফুলবাড়ীর বিভিন্ন অরাজনৈতিক পেশাজীবী সংগঠন ও ফুলবাড়ীবাসীর ব্যানারে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সাবেক পৌর মেয়র মানিক সরকার বলেন, ফুলবাড়ী এলাকার তিন ফসলি উর্বর জমি নষ্ট করে ফুলবাড়ীর মানুষ কয়লা খনি চায় না। এ সময় তিনি এশিয়া এনার্জি কর্তৃক দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৩৩১
আপনার মতামত জানানঃ