চলতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় দৈনিক আক্রান্ত-মৃত্যু কমতে শুরু করলেও, গত জুলাই থেকে ডেল্টার প্রভাবে দেশটিতে প্রতিদিন নতুন শনাক্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি, ডেল্টার প্রকোপের ফলে ব্যাপক ঝুঁকিতে পড়েছে দেশটির ১২ বা তার চেয়ে কমবয়সী শিশুরা। কারণ, এই বয়সী শিশুদের জন্য উপযোগী কোনো টিকা এখন পর্যন্ত বাজারে আসেনি।
তবে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপে সারা বিশ্বেই শিশুরা সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছে। দক্ষিণ এশিয়াও এই ঝুঁকির বাইরে নয়। ভারত ও বাংলাদেশেও শিশুরা সংক্রমিত হচ্ছে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ সম্প্রতি অপ্রাপ্তবয়স্কদের টিকার আওতায় আনতে টিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছে, কিন্তু এক্ষেত্রে ১৩ থেকে ১৭ বয়সী কিশোর-কিশোরীদের টিকা দেওয়া হচ্ছে। তবে দরিদ্র দেশগুলোর যেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের টিকা দিতেই নাজেহাল অবস্থা, সেখানে শিশুদের টিকার আওতায় আনাটা এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
যে কারণে শিশুদের মধ্যে বাড়ছে সংক্রমণ
দেশটির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিস (এইচএইচএস)-এর গত শুক্রবারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুদের সবার দেহে করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ধরনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
এইচএইচএস গত শনিবার আর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের হাসপাতালগুলোতে বর্তমানে ভর্তি থাকা শিশুর সংখ্যা পৌঁছেছে ১ হাজার ৯০২ জনে।
এর বাইরে আরও বহু সংখ্যক শিশু সম্প্রতি করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছে বলেও বিবৃতিতে বলা হয়েছে। আক্রান্ত ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশুদের বয়স ১২ বা তার নিচে বলে জানিয়েছে এইইচএইচএস।
দেশটির শিশুরোগ গবেষণা ও চিকিৎসা বিষয়ক শীর্ষ সরকারি প্রতিষ্ঠান আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকসের সাবেক প্রেসিডেন্ট স্যালি গোজা এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘এটি গত বছরের কোভিডের মতো নয়। বরং তার চেয়েও খারাপ এবং আমাদের শিশুরা যে চরম ঝুঁকিতে আছে, সাম্প্রতিক চিত্র তারই উদাহারণ।’
২০২০ সালে মহামারি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত করোনায় মোট আক্রান্ত ও মৃত্যুর হিসেবে বিশ্বের দেশসমূহের মধ্যে এখনও শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এ পর্যন্ত দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৩ কোটি ৭৪ লাখ ৩৫ হাজার ৮৩৫ জন এবং এ রোগে মারা গেছেন মোট ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৪৩৯ জন।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয় ডেল্টার প্রকোপে শিশুদের করোনায় সংক্রমণ বেড়েছে দেশেও। জুলাইয়ে এই সংক্রমণ বাড়তে থাকে। ওই সময় ঢাকা শিশু হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ও ঢাকা মেডিকেলে প্রতিদিন গড়ে করোনায় আক্রান্ত ২০ শিশু ভর্তি হয়েছিল; মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে শিশু আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
গত জুলাই মাসে চট্টগ্রামে গবেষণার জন্য নির্বাচিত করোনাভাইরাস আক্রান্ত ১২ শিশুর সবাইকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা যায়, আক্রান্ত শিশুদের ৮০ ভাগেরই বয়স ১০ বছরের নিচে। সর্বনিম্ন আট মাস বয়সের শিশুর মধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে।
গবেষক দলের অন্য গবেষণা অনুযায়ী, প্রাপ্ত বয়স্ক কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে ৮০ ভাগ রোগী পুরুষ হলেও শিশুদের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। শিশুরাও সমানভাবে এই ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত ও আক্রান্ত হচ্ছে। ৫০ ভাগ ছেলে শিশু এবং ৫০ ভাগ মেয়ে শিশুর মধ্যে এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি দেখা গেছে। ৯৫ ভাগ শিশুর মধ্যেই জ্বরের লক্ষণ এবং ৭০ ভাগ শিশুর সর্দি ও কাশি ছিল। তবে, এক শিশু পুরোপুরি উপসর্গহীন ছিল।
গবেষক দলের অন্যতম ডা. সঞ্জয় কান্তি বিশ্বাস বলেন, ‘গত এক বছরে আমরা তেমন উল্লেখযোগ্য হারে শিশুদের মধ্যে কোভিড-১৯ দেখতে পাইনি হাসপাতালে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে আমাদের গবেষণা থেকে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ছোট শিশুরা নিজের অনুভূতি কিংবা দুর্বলতা প্রকাশ করতে না পারায়, অনেকেই কোভিড টেস্ট বা শনাক্তকরণের আওতায় আসবে না, যা চিন্তার বিষয়ও বটে।’
সান অ্যান্তনিওতে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য বিজ্ঞান কেন্দ্রের সহযোগী অধ্যাপক ডা. টেস বার্টন বলেন, করোনার নতুন অতিসংক্রামক ধরন শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। শিশুদের ক্ষেত্রে এখনো ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। তাদের সংক্রমণ প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে বেশি মারাত্মক। কিন্তু এই ধরনে আক্রান্ত হয়ে শিশুদের হাসপাতালে ভর্তি হতে দেখা যাচ্ছে।
এই চিকিৎসক আরও বলেন, গত কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েকটি শিশুকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে দেখেছি। করোনার টিকা নেওয়া হয়নি এমন সব পরিবারের সদস্য তারা।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এরলিন্দা উল্লোয়া বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক অঞ্চলে নির্দিষ্টভাবে শিশুদের আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। কারণ, তাদের টিকা দেওয়া হয়নি, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে তারা। যে কারণে ডেল্টা ধরন শিশুদের মধ্যে বেশি ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে।
শিশুদের মধ্যে করোনার লক্ষণ
চিকিৎসকরা বারবার বলছেন, শিশুরা করোনার কারণে খুব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছে না। কিন্তু তারপরও সব রকম ভাবে সতর্ক থাকা জরুরি। শিশুদের মধ্যে সাধারণত মৃদু উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। যেগুলো প্রথমে অনেক অভিভাবকই করোনার উপসর্গ বলে বুঝতে পারছেন না। এক নজর দেখে নেয়া যাক, সেগুলি কী।
পেটে ব্যথা: চলতি বছর রূপ পরিবর্তিত করোনা সংক্রমণের অন্যতম উপসর্গ পেটের সমস্যা। শিশুদের মধ্যেও সেটা দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ পেট ফুলে যাওয়া, পেটে ব্যথা, হজমের সমস্যা, পেট ভারী লাগা-এ সবই হতে পারে করোনার উপসর্গ। হঠাৎ যদি আপনার সন্তান খেতে না চায় এবং খিদে না থাকার অভিযোগ করে, তা হলেও সতর্ক হতে হবে।
ডায়রিয়া: শিশুদের মধ্যে বমি এবং খুব বেশি পেট খারাপের লক্ষণ দেখলে সাবধান হতে হবে। শিশুদের কোভিড সংক্রমণের অন্যতম উপসর্গ ডায়রিয়া।
জ্বর: জ্বর বেশির ভাগ ভাইরাস অসুখের অন্যতম উপসর্গ। তবে করোনার কারণে জ্বর এলে সঙ্গে কাঁপুনি, ক্লান্তিভাবও দেখা যাচ্ছে। তাই সতর্ক থাকুন। এমনিতে শিশুদের একটু বেশি জ্বর আসতেই পারে। কখনও কখনও শরীরের তাপমাত্রা ১০২ ডিগ্রিও ছুঁতে পারে। তবে সাধারণত ২-৩ দিনের মধ্যে এই জ্বর ঠিক হয়ে যেতে দেখা গেছে। তবে আপনার সন্তানের জ্বর যদি ৫ দিনের বেশি থাকে, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
কাশি-ঠাণ্ডা লাগা: প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মধ্যে করোনার জন্য ফুসফুসে সংক্রমণ খুব একটা শোনা যায়নি। তবে ঠাণ্ডা লাগা, টানা কাশি, গলা ব্যথার মতো কিছু উপসর্গ দেখা দিতেও পারে। পাশাপাশি জ্বর বা পেটের সমস্যা থাকলে অবশ্যই করোনা পরীক্ষা করান।
ক্লান্তিভাব: বাচ্চা কি হঠাৎ খুব ক্লান্ত বোধ করছে? অল্পতেই হাঁপিয়ে যাচ্ছে? টানা ঘুমের সমস্যা হচ্ছে? এগুলিও সংক্রমণের লক্ষণ হতে পারে।
অদ্ভুত র্যাশ: শিশুদের মধ্যে র্যাশ বা অন্য ত্বকের সমস্যা এবং ‘কোভিড টোজ’ প্রথম দেখা গিয়েছিল গত বছরই। প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি নানা রকম ত্বকের সমস্যা বাচ্চাদের মধ্যে কোভিড সংক্রমণের অন্যতম উপসর্গ। এমনিতে শিশুদের নানা রকম র্যাশ লেগেই থাকে। তবে যদি তাদের শরীরে কোনও অদ্ভুত লালচে দাগ, বা ফুশকুরি বা র্যাশ চোখে পড়ে তা হলে সতর্ক হন। হাত পায়ের নখ হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে কি না, সেটাও খেয়াল রাখুন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪২৭
আপনার মতামত জানানঃ