প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় এই ভাইরাসের প্রকোপ বেশি দেখা যায় পশ্চিমা দেশগুলোতে। তারপরও সেসব দেশের তুলনায় এই ভাইরাসে বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তানে। গবেষণায় এমনই তথ্য উঠে এসেছে।
আগা খান বিশ্ববিদ্যালয়, করাচির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজেস অ্যান্ড ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ, লাহোরের শিশু হাসপাতাল ও রাওয়ালপিন্ডির বেনজির ভুট্টো হাসপাতাল-এর এক সম্মিলিত গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জানা গেছে, পাকিস্তানে ২০২০ সালে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৫৯ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। দেশটিতে করোনা আক্রান্ত হওয়া শিশুদের মৃত্যুহার ১৪ শতাংশ। বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় এ হার অস্বাভাবিক রকমের বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুদানে পাকিস্তানে এ গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, পাকিস্তানে যেসব শিশুর করোনা সংক্রমণের ধরন মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার ছিল, তাদের প্রতি সাতজনে একজন মারা গেছে। মৃত্যুর এ হার পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। পশ্চিমা দেশগুলোতে একই রকমের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সেসব দেশে কোভিড আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুহার ১ শতাংশের কম।
জিও নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১ হাজার ১০০ জন শিশুকে নমুনা হিসেবে নিয়ে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছে। নমুনার মধ্যে নবজাতক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের শিশু ছিল।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব শিশু অপুষ্টি, ক্যানসার ও হৃদ্রোগের মতো শারীরিক জটিলতায় ভুগছে, তাদের কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ঝুঁকি বেশি। এ ধরনের শারীরিক জটিলতা থাকা শিশুদের যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, তাদের প্রতি পাঁচজনে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ধরনের শিশুদের মৃত্যু হার প্রায় ২০ শতাংশ। আর পাকিস্তানে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা শিশুদের যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, তাদের প্রতি আটজনে একজন শিশু মারা গেছে।
গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী, যেসব শিশু মারা গেছে, তারা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মাথায় তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রদাহ ছড়িয়ে পড়েছিল। হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি, মস্তিষ্ক, ত্বক এবং পাচনতন্ত্রে প্রদাহ হয়েছিল। এ ছাড়া ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আরেকটি কারণ ছিল শ্বাসযন্ত্রে জটিলতা।
গবেষকেরা বলছেন, ২০২০–এর তুলনায় ২০২১ সালে বেশির ভাগ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ধারণা করা যায়, পাকিস্তানে মহামারির শুরুর দিকের করোনার ধরনগুলোর তুলনায় পরবর্তী সময়ে শনাক্ত হওয়া ধরনগুলো বেশি প্রাণঘাতী ছিল।
পাকিস্তানে পরিচালিত গবেষণাটির মুখ্য অনুসন্ধানকারী হিসেবে কাজ করেছেন আগা খান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কালাব আব্বাস, ফাইজা জেহান এবং শাজিয়া মহসিন। তারা বলেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে সার্বিকভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মৃত্যুহার কম। এটি এখন পরিষ্কার যে শিশুদের জন্য কোভিড–১৯ বিপজ্জনক রোগ নয়। ভাইরাসটির অনবরত পরিবর্তন হচ্ছে এবং চিকিৎসাকর্মীদের উচিত হালনাগাদকৃত চিকিৎসা নির্দেশনা মেনে চলা।
গবেষকেরা আরও বলেন, পাকিস্তানের শিশুবিশেষজ্ঞরা এখন গুরুতর অসুস্থ শিশুদের চিকিৎসাসংক্রান্ত নির্দেশনায় কয়েকটি পরিবর্তন নিয়ে আসার পরামর্শ দিচ্ছেন।
পাকিস্তানে যেসব শিশুর করোনা সংক্রমণের ধরন মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার ছিল, তাদের প্রতি সাতজনে একজন মারা গেছে। মৃত্যুর এ হার পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, করোনাকালে শিশুমৃত্যু বেড়েছে৷ তবে মৃত্যুর কারণ ভেঙে পড়া অর্থনীতি৷ গবেষকরা বলছেন, সারা বিশ্বে অন্তত দু লাখ ৬৭ লাখ শিশুর মৃত্যুতে ভূমিকা রেখেছে মা-বাবার অর্থনৈতিক দুরবস্থা৷
বিশ্বব্যাংকের গবেষকদল ১২৮টি দেশের তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছেন সেসব দেশে ২০২০ সালে শিশুমৃত্যু যেমনটি অনুমান করা হয়েছিল তার চেয়ে অন্তত সাত ভাগ বেড়েছে৷ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশে৷
গত দুই বছর থেকে কোভিড-১৯ অসুস্থতার চিকিৎসা সম্পর্কে চিকিৎসকরা অনেক কিছু শিখেছেন এবং তাদের অভিজ্ঞতা বেড়েছে। শিশুদের কোভিড চিকিৎসা বিষয়েও শিশু বিশেষজ্ঞরা অধিক সংবেদনশীল ও প্রশিক্ষিত হয়েছেন। ইতোমধ্যে ‘মাল্টি-সিস্টেম ইনফ্ল্যামেটরি সিনড্রোম (MIS-C) আক্রান্তদের কেমন পর্যবেক্ষণ, তদারকি ও যত্ন প্রয়োজন, সে সম্পর্কে ধারণা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, অধিকসংখ্যক শিশু রোগীর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে অসুস্থতা ও সতর্কতার লক্ষণ সম্পর্কে পিতা-মাতাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সচেতনতা জোরদার করতে হবে। উচ্চ-নির্ভরশীলতা ইউনিট (HDU) এবং নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটগুলোসহ শিশুদের জন্য আরও কোভিড ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যবিধি শিশুর জন্য একই। পিতা-মাতার মাস্ক ব্যবহার, হাত ধোওয়ার স্বাস্থ্যবিধি এবং শারীরিক বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, গণসমাবেশ নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য এবং শিশুদেরও এ ব্যাপারে শিক্ষা দিতে হবে।
তারা বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী ২ থেকে ৫ বছর বয়সের শিশুদের মাস্ক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের কোভিড উপযুক্ত আচরণ অনুসরণ করতেই হবে। মা-বাবার উচিত বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলো লক্ষ করা এবং শিশু নির্যাতন ও সহিংসতা রোধে সজাগ থাকা। এছাড়াও স্ক্রিনের সময় অর্থাৎ মোবাইল, ট্যাব বা ল্যাপটপের ব্যবহার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা অবশ্য করণীয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৩
আপনার মতামত জানানঃ