আফগানিস্তানে তালিবানের হিংস্র সহিংসতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের বন্দুকের সামনে আসা যাকে পাচ্ছে তার ওপরই চলছে গুলির নির্যাতন। তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না দেশটির সাধারণ মানুষের পাশাপাশি নারী ও শিশুরাও। এদিকে গণমাধ্যমের ওপর তালিবান বরাবরই সহিংসতাপ্রবণ ছিল। ইদানিং যেন তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
রেডিও স্টেশনের ব্যবস্থাপক নিহত, সাংবাদিককে অপহরণ
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের এক রেডিও স্টেশনের ব্যবস্থাপককে হত্যা এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় হেলমান্দ প্রদেশের এক সাংবাদিককে অপহরণ করা হয়েছে। দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী তালিবানের সন্দেহভাজন যোদ্ধারা এই হত্যাকাণ্ড এবং অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে গতকাল সোমবার স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
দেশটিতে গণমাধ্যম কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে তালিবানের টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন। ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, রোববার কাবুলের পাকতিয়া ঘাগ রেডিও স্টেশনের ব্যবস্থাপক তুফান ওমরকে পরিকল্পিতভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আফগানিস্তানের স্বাধীন গণমাধ্যমের সমর্থনকারী গোষ্ঠী এনএআইয়ের একজন কর্মকর্তা ছিলেন তিনি।
এনএআইয়ের প্রধান মুজিব খেলওয়াতগার বলেছেন, অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা ওমরকে হত্যা করেছেন…তিনি উদার মানুষ ছিলেন… স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য আমাদের লক্ষ্যে পরিণত করা হচ্ছে। কাবুলের কর্মকর্তারা এই হামলার জন্য তালিবানের যোদ্ধাদের সন্দেহ করছেন।
দক্ষিণাঞ্চলীয় হেলমান্দ প্রদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, রোববার স্থানীয় সাংবাদিক নেমাতুল্লাহ হেমাতকে প্রাদেশিক রাজধানী লশকর গাহের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে তালিবানের যোদ্ধারা। স্থানীয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ঘারঘাশত টিভিতেও কর্মরত ছিলেন তিনি। এই টেলিভিশনের প্রধান রাজওয়ান মিয়াখেল বলেছেন, হেমাতকে তালিবানের সদস্যরা কোথায় নিয়ে গেছে তার কোনও সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।
তালিবানের একজন মুখপাত্র রয়টার্সকে বলেছেন, কাবুলে হত্যাকাণ্ড অথবা হেলমান্দে অপহৃত সাংবাদিকের ব্যাপারে কোন তথ্য তার কাছে নেই।
আফগানিস্তানের সংবাদমাধ্যম সংগঠনগুলোর একটি জোট মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং প্রতিনিধি পরিষদের নেতাদের কাছে লেখা এক চিঠিতে আফগান সাংবাদিক এবং কর্মচারীদের বিশেষ অভিবাসন ভিসা অনুমোদনের আহ্বান জানিয়েছে।
তালিবানের হাতে আফগান সরকারের গণমাধ্যম বিভাগের প্রধান নিহত
আফগান সরকারের গণমাধ্যম প্রধান দাওয়া খান মেনাপালকে গুলি করে হত্যা করেছে তালিবান। রাজধানী কাবুলের দারুল আমান এলাকার একটি মসজিদে গত শুক্রবার তাকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে দেশটির সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মীরওয়াইস স্তানিকজাই হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন দুর্ভাগ্যজনকভাবে আবার এক কাপুরুষোচিত সন্ত্রাস হামলায় এক দেশপ্রেমিক আফগান প্রাণ দিলেন।
এদিকে তালিবান এই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব স্বীকার করেছে। এ ব্যাপারে তালিবানের মুখপাত্র জাহিবুল্লাহ মুজাহিদ গণমাধ্যমের কাছে পাঠানো বার্তায় জানিয়েছেন, মেনাপালকে মুজাহিদিনরা বিশেষ অভিযানে হত্যা করেছে।
চলমান সহিংসতার মধ্যে ৫১ সংবাদমাধ্যম বন্ধ
আফগানিস্তানে চলমান অস্থিরতার মধ্যে গত তিন মাসে মোট ৫১টি গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে। টলো নিউজের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ইয়াহু নিউজ।
আফগানিস্তানের তথ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চারটি টেলিভিশন নেটওয়ার্কসহ ১৬টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে।
আফগানিস্তানের তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী কাসিম ওয়াফায়েজাদা বলেছেন, এখন পর্যন্ত ৩৫ টি গণমাধ্যম তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে, ৬ টির বেশি সংবাদমাধ্যম তালিবানদের হাতে পড়েছে এবং তাদের কার্যক্রম প্রকাশের জন্য ব্যবহার হচ্ছে।
হিলমান্দ, কান্দাহার, বাদাখশান, তাখার, বাঘলান, সামানগান, বালখ, সার-ই-পুল, জাওজান, ফারইয়াব, নুরিস্তান এবং বাঘি এলাকায় ওই সংবাদমাধ্যমগুলোর কার্যালয়।
জানা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১০০০ রিপোর্টার এবং গণমাধ্যমকর্মী চাকরি হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে দেড় শতাধিক নারী রয়েছেন। এমনকি দুই সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন।
চলতি বছরে ৩০ গণমাধ্যম কর্মী হতাহত
আফগানিস্তানে চলতি বছরের প্রথম ভাগে কমপক্ষে ৩০ গণমাধ্যম কর্মী সন্ত্রাসীদের হাতে হতাহত হয়েছেন। এদের বেশিরভাগকে সরকারি কর্মকর্তারাও হুমকি দিয়েছেন বলে আফগানিস্তানের একটি অলাভজনক সংস্থা নাইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
নাইয়ের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে খামা সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, কিলিদ গোষ্ঠীর এক সাংবাদিককে কাবুল শহরের একটি ঘটনা কভার করতে বাধা দেওয়া দিয়েছিল পুলিশ। তাকে কাবুল পুলিশ হুমকিও দিয়েছিল। অন্যদিকে, আফগান পিস পাবলিকেশন ওয়াচের এক সাংবাদিককে সরকারি কর্মকর্তারা অপমান করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও, আফগানিস্তানের বাওয়ার মিডিয়ার ২৬ জন কর্মচারীকে উত্তর বালখ প্রদেশে ছাঁটাই করা হয়েছে এবং চার কর্মচারীকে মিডিয়া আউটলেটগুলোকে তথ্য দেওয়ার জন্য ভাইস-প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ বরখাস্ত করেছেন।
নাই গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনায় নিন্দা করেছে এবং এটিকে দেশের শ্রম আইনের ‘বিরুদ্ধে’ বলে অভিহিত করেছে।
আন্তর্জাতিক অধিকার রক্ষা সংস্থাগুলির দাবি, এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে সাংবাদিকদের অবস্থা সব চেয়ে ভয়াবহ। চলতি বছরে ৩০ জন সাংবাদিককে খুন করা হয়েছে। কাজ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন বহু সাংবাদিক। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে সরকার এতটুকু ভাবিত নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪১
আপনার মতামত জানানঃ