আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে গত চার বছরে একাধিকবার কথা দিয়েও কথা না রাখা মিয়ানমার রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে বাংলাদেশকে ফের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। গত ৬ আগস্ট আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এক বৈঠকে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের প্রতিনিধি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনকে এ প্রস্তাব দেন। সঙ্কট সমাধানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য গত চার বছরে মিয়ানমার সরকার তিনবার ঘোষণা দিয়ে একবারও কথা রাখেনি। যদিও প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে এখনও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেনি দেশটি। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক ও চীন-রাশিয়া-ভারতের মতো পরাশক্তিগুলোর স্বার্থান্বেষী মনোভাবের কারণে রোহিঙ্গা সঙ্কট দিন দিন স্থায়ী ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য।
একই নাটক মঞ্চস্থ করছে মিয়ানমার
গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে ঢাকার সঙ্গে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বার্তা বিনিময় করেনি নেপিডো। বাংলাদেশের তরফ থেকে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত দফায় দফায় নেপিডোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালানো হলেও তাদের থেকে উৎসাহব্যঞ্জক জবাব পাওয়া যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়ক্ষেপণ করা এবং কথা দিয়ে কথা না রাখা মিয়ানমারের পুরনো কৌশল। চলমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে ঢাকাকে বহুমুখী কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।
এবারের মিয়ানমারের প্রস্তাব প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন সময়ের আলোকে বলেন, ‘গত ৬ আগস্ট আসিয়ানের বৈঠকে মিয়ানমারের প্রতিনিধি রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে কথা বলেছেন। তারা এই ইস্যুতে দ্বিপাক্ষিকভাবে কাজ করতে চান।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ওই বৈঠকে মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি ছাড়া আসিয়ানের অন্য সদস্যরা সঙ্কট নিয়ে কোনো কথা বলেননি। তবে দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধানের জন্য মিয়ানমারের প্রস্তাবকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি।’
মিয়ানমার এর আগেও বহুবার এমন প্রস্তাব দিয়েছে, কথা দিয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথা রাখেনি। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মিয়ানমার এবারও কথা রাখবে কি না তা বের করার দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের। তারা আন্তর্জাতিক ফোরামে যেহেতু এই কথা বলেছে, আমরা তা বিশ্বাস করতে চাই।’
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, ‘সেনা অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে এখন ভিন্ন পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতিতে দেশটিতে রোহিঙ্গা ইস্যু অনেক পিছিয়ে আছে। সমাধানের জন্য বাংলাদেশকেই বহুমুখী কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।’
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, মিয়ানমারে চলমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এরই মধ্যে সঙ্কট সমাধানে ভিন্নধর্মী কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে বাংলাদেশ। এর আওতায় দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক এবং বৈশ্বিক ফোরামগুলোকে সঙ্কট সমাধানে ব্যবহারের চেষ্টা চলছে।
গত ৭ জুন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন আসিয়ান অঞ্চলে নিযুক্ত বাংলাদেশের দূতদের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে ওইসব দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনার নির্দেশ দেন। বৈঠকে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘আসিয়ান দেশগুলো এই ইস্যুতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশগুলোকে এই সঙ্কট কাটাতে কাজে লাগাতে হবে।’
নিউইয়র্ক সফরে গিয়ে গত ১৫ জুন রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে জাতিসংঘকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির কাছে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে গত ৯ জুন সহায়তা চান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। এ ছাড়া এই ইস্যুতে বেইজিংয়ের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে যোগাযোগ রাখছে ঢাকা।
বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব ও প্রত্যাখান
এদিকে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে ১৬টি দেশকে শরণার্থীদের বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে বলেছে, আশ্রয়দাতা দেশগুলোকে শরণার্থীদের সেসব দেশের নাগরিকদের মতপ্রকাশ, চলাচল, ব্যবসা করা, সম্পত্তি কেনাবেচাসহ ভোট উৎসবে অংশ নেওয়ার অধিকার দিতে হবে।
এজন্য বিশ্বব্যাংক তাদের দুই হাজার কোটি ডলারের তহবিল থেকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে সহযোগিতা করবে। বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদন সামনে আসলে তা প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ। পরে সংস্থাটির ঢাকা অফিস এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে এমন কোনো প্রস্তাব দেয়নি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা আমাদের দেশে কোনো শরণার্থী নেই। মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ সাময়িক আশ্রয় দিয়েছে। আর মিয়ানমার সরকার বলেছে যে তাদের ফিরিয়ে নেবে।’
বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদন বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করেছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এই ইস্যুতে আমাদের মতামত জানতে চেয়েছিল। তাদের জানিয়ে দিয়েছি, আমরা এমন শর্তে বিশ্বব্যাংক থেকে কোনো সহায়তা চাই না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদন এখনও পরিষ্কার নয়। বিষয়টি এখনও পাবলিক হয়নি। তাই জানা যাচ্ছে না যে, ওই প্রতিবেদনটি কী ১৬টি দেশের জন্য পরামর্শ হিসেবে দিয়েছে নাকি দেশভিত্তিক ‘কান্ট্রি রিপোর্টে’ বলেছে। কেননা ১৬ দেশকে পরামর্শ দেওয়া এক বিষয় আর কান্ট্রি প্রোফাইলে বলা আরেক বিষয়। পরামর্শ তারা দিতেই পারে; কিন্তু তা মানা না-মানা সংশ্লিষ্ট দেশের ওপর নির্ভর করে।’
২০১৭ সালের আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কমপক্ষে লাখ চারেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছিল বাংলাদেশে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সেনা চৌকিতে জঙ্গি হামলার অজুহাতে ওই রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে এর পরের কয়েক মাসে বাংলাদেশে আসে আরও সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে এখন প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে।
পরাশক্তিগুলো যে কারণে মিয়ানমারের পক্ষে
সম্প্রতি জেনিভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ৪৭তম অধিবেশনে মিয়ানমারে দ্রুত পুনর্বাসনের মাধ্যমে চলমান রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের লক্ষ্যকে সামনে রেখে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। ‘রোহিঙ্গা মুসলিম ও মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি বাংলাদেশের উদ্যোগে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) সব সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হয়।
বিভিন্ন বিষয়ে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে মতভেদ দেখা গেলেও দীর্ঘ আলোচনা শেষে প্রস্তাবটি মানবাধিকার পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বলা হচ্ছে, এই প্রস্তাবের মাধ্যমে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পক্ষে জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের কোন ফোরামে রোহিঙ্গাবিষয়ক কোন রেজুলেশন সবার সম্মতিতে গৃহীত হলো।
তবে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো যারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে মোটাদাগে ভূমিকা রাখতে পারতো তারা বাংলাদেশকে আশানুরূপ সহযোগিতা করেনি। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে চীনের ওপর বাংলাদেশ আস্থা রাখলেও চীন বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপনের পরিবর্তে দ্বিপক্ষীয় সমাধানের পক্ষে। যেন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ভিন্নখাতে যায়। নিরাপত্তা পরিষদে তারা বার বার ভেটো প্রয়োগ করেছে, প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছে।
কেবল চীনের আশকারা পেয়েই মিয়ানমার নানা অজুহাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রেখেছে। এক পর্যায়ে চাপ দিয়ে চুক্তি করিয়েছে, অন্তরালে থেকে প্রত্যাবাসন নাটকও করিয়েছে৷ জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও চীন ও রাশিয়ার ভূমিকার কারণে নিরাপত্তা পরিষদ কোনরকম ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
জাতিসংঘ গাম্বিয়ার আবেদনের প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ণ নির্যাতনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শুনানিতে সম্মতি দেয়। তবে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়ার সময়টাতে মিয়ানমারকে সাহস যোগাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশটি সফর করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তখন মিয়ানমারের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাসহ কয়েক শ কোটি ডলার প্রকল্পের চুক্তিও সই করে চীন।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের পাশাপাশি ভারতের মতো বন্ধুদেশকেও কখনও পাশে পায়নি বাংলাদেশ। চীন ও ভারত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুটি দেশই কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। রাশিয়াও মিয়ানমারের অস্ত্রের বাজার দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। নজর আছে খনিজসম্পদের দিকেও। ইতিমধ্যে রাশিয়ার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘গ্যাসপম’ মিয়ানমারে অফিস খুলেছে।
অন্যদিকে, অং সান সুচির সময়ে, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে প্রচুর অর্থ লগ্নি করেছে জাপান। পাশাপাশি রাখাইনের মংডুর কাছাকাছি পরিকল্পিত ইকোনমিক জোনে জাপান বিশাল লগ্নিরও পরিকল্পনা করেছে। জাপান জান্তা সরকারের প্রতি সমর্থন না জানালেও খুব একটা বিরোধিতাও করছে না।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭৪৮
আপনার মতামত জানানঃ