ঈদের সময় লকডাউন উঠিয়ে নিয়ে বলা হলো, এরপর সবথেকে কঠোর লকডাউন দেওয়া হবে। অথচ কথিত সেই কঠোর লকডাউনে শ্রমিকেরা যখন গ্রামে, তখন পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও সরকার হুট করে চলতি মাস থেকে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত জানায়। এতে গ্রামে থাকা শ্রমিকেরা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে, যে যেভাবে পেরেছে ঢাকায় ফিরেছে। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়েছে। লকডাউনের সুফল পাওয়ার আশাও হয়েছে ধূলিসাৎ। তবে সরকারের হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে পোশাক শিল্পে বিপুল অঙ্কের ক্রয়াদেশের খবর। আর সেজন্যই শ্রমিকদের করোনার ঝুঁকিতে ফেলতেও দ্বিধা করেনি সরকার।
মূলত রপ্তানি আদেশ বাঁচাতেই সরকারকে বুঝিয়ে দেশে বন্ধ থাকা তৈরি পোশাক কারখানাগুলো তড়িঘড়ি করে খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকরা। অনেক ক্রয়াদেশ যেখানে বাতিল হয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের পাওয়া এই বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ তৈরি পোশাক খাতের সংকট দূর ও রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেই শুধু সহায়ক হবে না, বরং করোনায় সৃষ্ট দেশের মন্দা অর্থনীতির উত্তরণেও সহায়ক হবে। এ কারণে এই বিপুল ক্রয়াদেশ তারা কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাননি।
৮৫ হাজার কোটি টাকার ক্রয়াদেশ
চলতি বছরের জুন ও জুলাই মাসে তৈরি পোশাকের প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্রয়াদেশ পেয়েছে বাংলাদেশ। দেশি টাকায় এর পরিমাণ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। এর সিংহভাগ এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের কাছ থেকে।
শর্ত অনুযায়ী, এসব ক্রয়াদেশ চলতি আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে শিপমেন্ট করতে হবে। এদিকে, করোনার লকডাউনে দেশে পোশাক কারখানা বন্ধ থাকায় বায়ারদের নির্ধারিত শিডিউল অনুযায়ী ক্রয়াদেশ পূরণে শঙ্কা তৈরি হয়।
কারণ উৎপাদন-সক্ষমতা অনুযায়ী, ক্রয়াদেশ পাওয়া বেশির ভাগ কারখানার শিডিউল আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত বুকিং হয়ে গেছে। আরও ক্রয়াদেশ পাইপলাইনে রয়ে গেছে। কিন্তু কারখানা বন্ধ থাকায় শঙ্কিত ছিলেন ক্রেতারা।
ক্রেতাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, শিডিউল অনুযায়ী শিপমেন্ট ডেলিভরি যাতে কোনো অবস্থাতেই হেরফের না হয়। যদি এ রকম কোনো আশঙ্কা থাকে, তাহলে তাদের আগেভাগেই জানিয়ে দিতে, যাতে তারা এই অর্ডার সময় থাকতেই প্রতিযোগী অন্য কোনো দেশে সরিয়ে নিতে পারেন।
তা ছাড়া প্রথমবারের মতো ভারত ও মিয়ানমারে ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয়েছে। আগে থেকেই চীন থেকে স্থানান্তরিত বিপুল পরিমাণ অর্ডারও বাংলাদেশে এসেছে। প্রতিনিয়ত আসছে। ফলে এসব ক্রয়াদেশের শিডিউল রক্ষার চাপ উদ্যোক্তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে তাদের হাতে কারখানা চালু এবং উৎপাদন অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প ছিল না।
শ্রমিকদের ফেরার পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না সরকার
ঢাকার বাইরে থেকে হাজার হাজার শ্রমিক রাজধানীতে ফেরার কারণে যে পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে তার জন্য সরকার প্রস্তুত ছিল না। তবুও করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে জারি করা কঠোর বিধি-নিষেধের মধ্যেও শুক্রবার শর্ত সাপেক্ষে রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা রোববার থেকে খুলে দেয়ার কথা ঘোষণা করে সরকার। এর পরপরই রাজধানীতে ফিরতে থাকে হাজার হাজার শ্রমিক।
এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, বিভিন্ন কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে: যার মধ্যে একটি হচ্ছে শ্রমিকরা চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে হয়তো রাজধানীমুখী হয়েছে, অথবা যেসব কারখানা শীর্ষ স্থানে নেই তারা হয়তো তাদের সংগঠনের শর্ত মানে নি, যে কারণে তারা শ্রমিকদের চলে আসার নির্দেশ দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘তারা আসা শুরু করলে একটা পরিস্থিতির তৈরি হয়, যার জন্য সরকার প্রস্তুত ছিল না, অথবা তারা দায়িত্বশীলভাবে এটা করবে, সেটাই আমাদের ধারণা ছিল।’
এদিকে, শনিবার মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া এবং মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাটে হাজার হাজার মানুষকে নদী পার হতে দেখা গেছে। যানবাহন পরিবর্তন করে, পণ্যবাহী যানের ছাদে ওঠে বা হেঁটে তাদের ঢাকার পথে রওনা দিতে দেখা গেছে। তাদের এমন ভোগান্তি কমাতে শনিবার সন্ধ্যার পর আরেক ঘোষণায় বলা হয় যে, রাত আটটা থেকে পরের দিন রোববার বেলা ১২টা পর্যন্ত গণপরিবহন চলবে।
পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ায় সংক্রমণ বাড়বে
দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলমান বিধি নিষেধের (লকডাউন) মধ্যে পোশাক কারখানা খোলায় ফের সংক্রমণ বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল রোববার (০১ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর মহাখালীর বিসিপিএস মিলনায়তনে প্রথমবর্ষের এমবিবিএস ক্লাসের (২০২০-২১) উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে তিনি এ কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ কর্মস্থলে (রাজধানী) যোগ দিয়েছেন। ঢাকায় ফিরতে তারা কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানেননি। ফলে করোনা সংক্রমণ আরও বাড়বে। জীবনের জন্য জীবিকার দরকার হয়। এজন্য সরকারকে সবকিছু নিয়েই ভাবতে হচ্ছে।
জাহিদ মালেক বলেন, বিশ্বের অনেক দেশ খুলে দিয়েছিল আবার বন্ধ করে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতে কারফিউ দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে মাস্ক পড়ার বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়েছিল কিন্তু আবার পড়তে বলেছে। অনেক জায়গায় রেস্টুরেন্ট খুলে দিয়েছিল আবার বন্ধ করে দিয়েছে। সবজায়গায় একই অবস্থা। সেজন্য আমাদেরকেও সাবধানে এগুতে হবে। সবকিছু ভেবেই এগুতে হবে যাতে সংক্রমণ বৃদ্ধি না পায়। কারণ সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে মৃত্যুর হার বাড়বে।
তিনি বলেন, ‘জীবনের জন্য জীবিকা দরকার আবার জীবিকার জন্য জীবনও তো থাকতে হবে। এই দুইটা ব্যালেন্স আমাদের করতে হয়। সরকারের সবদিকেই সে ব্যালেন্স করে চলতে হয়। কিন্তু ব্যালেন্স সবসময় রাখা যায় না।’
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ