বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নানা সমস্যার অন্যতম হচ্ছে যৌতুক প্রথা। সকল সমাজেই কমবেশি যৌতুক প্রথা প্রচলিত আছে। একটা সময় এটি নিদিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও কালের বিবর্তনে তা সব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে, যা বর্তমানে একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
বোনের যৌতুকের টাকা দিতে না পেরে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে কীটনাশক পান করে শিমুল (২৫) নামের এক যুবক আত্মহত্যা করেছেন। শুক্রবার (৩১ জুলাই) রাতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। শিমুল মাগুড়া ঠাটারীপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল জলিলের একমাত্র ছেলে।
এলাকাবাসী জানান, বাবার মৃত্যুর পর শিমুল তার পরিবারের হাল ধরেন। পাঁচ মাস আগে বোনের বিয়ে দেয়ার পর সম্প্রতি নিজেও বিয়ে করেন। বোনের যৌতুকের টাকা বাকি থাকায় সব সময় মানসিক চাপে ভুগতেন। নানা মোর্শেদ, মাস্টারের কাছে টাকাও ধার চান। এতে সাড়া না পাওয়ায় বুধবার (৩০ জুলাই) রাতে তার বাড়িসংলগ্ন নার্সারিতে কীটনাশক পান করেন। পরে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে শুক্রবার রাতে সেখানে তার মৃত্যু হয়। ঘরে নববধূ রেখে ওই যুবকের আত্মহত্যায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
কিশোরগঞ্জ থানার এসআই নোমান জানান, মানসিক চাপের কারণে ওই যুবক কীটনাশক পানে আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে।
যৌতুকের কারণ
যৌতুকের পিছনে রয়েছে নানা কারণ তন্মেধ্যে দারিদ্রতাই যৌতুকের প্রধান কারণ হিসাবে বিবেচিত করা হয়। দারিদ্রের কারণেই বরপক্ষ কনেপক্ষের কাছে অর্থ-সম্পদের দাবি-দাওয়া করে থাকে। তাছাড়া, এখন বহু সচ্ছল পরিবার কণে পক্ষের কাছে যৌতুকের দাবি করে থাকে এবং আজকাল কার শিক্ষিত সচেতন নাগরিকও যৌতুক দিচ্ছেন এবং নিচ্ছেন ।
তার কারণ তাদের মানসিকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে এ কুপ্রথার প্রভাব ব্যাপক আকারে জাল বিস্তার করেছে। তাছাড়াও আমাদের সমাজের ছেলেরা কণের পিতার অর্থ ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চায়। এদেশের অধিকাংশ নারী গৃহকর্মে কর্মস্থল থেকে পরনির্ভরশীল হয়ে স্বামীর সংসারে জীবন যাপন করে। ফলে কনেপক্ষ বরপক্ষকে যৌতুক প্রদান করে। এছাড়াও অনেকে, শ্বশুর বাড়িতে মেয়ের সুখের জন্য এবং মেয়ে যাতে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে সেজন্যও যৌতুক প্রথা সমাজে ব্যাপক ভাবে বিস্তার লাভ করছে।
যৌতুকের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের দশা
২০১৮ সালে করা পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্টে উঠে এসেছে, দেশের ৮৭ ভাগ মেয়ে পারিবারিক নিগ্রহ ও নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে যার সিংহভাগ শুধুমাত্র যৌতুকের কারণে। এছাড়াও নারী অধিকার সংরক্ষণের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালেই যৌতুকের কারণে ১০২ জন নারীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং আত্মহত্যার স্বীকার হয় ৪ জন।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের কারণে বিয়েতে নারীদের দেনমোহর বেড়েছে বলা হলেও এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ষাটের দশক থেকে শুরু হওয়া কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের কারণে নারীদের ক্ষমতায়ন হতে শুরু করে। তখন থেকে মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে যেতে শুরু করে। আর এর প্রভাব পড়ে বিয়ের বাজারে।
মুসলিম পারিবারিক আইনের কারণে যে দেনমোহরের পরিমাণ বাড়েনি; তার প্রমাণ মিলেছে পশ্চিমবঙ্গে গিয়েও। সেখানে এক হাজার পরিবারের সাক্ষাৎকার নিয়ে দেখা গেছে, কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের কারণে নারীদের ক্ষমতায়ন ও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের কারণে দেনমোহরের হার বেড়েছে। তবে গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর যৌতুকের কারণে ২০০ নারী মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশের চিত্র বলছে, যৌতুকের প্রবণতা ও হার দুটোই বেড়েছে।
যৌতুক বন্ধে করা আইনে ফাঁক ফোকর
যৌতুক একটি দন্ডনীয় অপরাধ। আমাদের দেশে যৌতুক বন্ধে ১৯৮০ সালে যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইন অনুযায়ী যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করলে সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদন্ড বা পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ড হতে পারে। ১৯৮৬ সালে এ আইন সংশোধিত করে বলা হয়েছে, কেউ যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করলে সর্বনিম্ন ১ বছর এবং সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদন্ড হতে পারে। ১৯৮৩ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের বিধান অনুযায়ী যৌতুকের কারণে নারীর মৃত্যু ঘটলে বা ঘটানোর চেষ্টা চালালে অপরাধীকে মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হবে। এত কঠিন আইন থাকা সত্ত্বেও উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে যৌতুক প্রথার বিস্তার।
বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ বলছেন, বাংলাদেশে যদিও ভয়ংকর আইনের বিধান রয়েছে কিন্তু এ আইনের তোয়াক্কা করে না কেউ। কেননা, আইনের যথেষ্ট ফাঁক-ফোকড় রয়েছে। যৌতুকের কারণে খুব বেশি মামলা হয় না। যাও হয় তার ৯০ শতাংশ বিচার পায় না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং দীর্ঘসূত্রতিকার কারণে যৌতুক প্রথা লাগামহীন ভাবে ছুটে চলেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২২৪৩
আপনার মতামত জানানঃ