করোনা ভাইরাসের সর্বশেষ আগ্রাসী ধরন ডেল্টার তাণ্ডবে গোটা বিশ্বই বিপর্যস্ত। ডেল্টার আগ্রাসী রূপ তার হিংস্রতা দেখাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যেও। ডেল্টার কারণে চতুর্থ ঢেউ আছড়ে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যসহ পশ্চিম এশিয়ায়। করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক পরিবর্তিত ধরন ডেল্টার প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ব্যাপকভাবে বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পক্ষ থেকে এ কথা বলা হয়েছে।একই সাথে ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের কেউই টিকা নেননি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, এই চতুর্থ ঢেউয়ের কারণ ভারতে পাওয়া করোনাভাইরাসের ডেল্টা রূপ। পশ্চিম এশিয়ার ২২টি দেশের মধ্যে ইরান, ইরাক, তিউনিসিয়া, লিবিয়া-সহ ১৫টি দেশেই করোনার এই ডেল্টা রূপের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তবে একই সাথে ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের কেউই টিকা নেননি।
জাতিসংঘের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক দফতর জানিয়েছি, গত চার সপ্তাহ ধরে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে গড়ে প্রতি সপ্তাহে ৩ লক্ষ ১০ হাজার মানুষ নতুন করে করোনা সংক্রমিত হচ্ছেন। সপ্তাহে গড়ে মৃত্যু হচ্ছে সাড়ে তিন হাজারের কাছাকাছি। সংক্রমণের এই পরিসংখ্যান ৫৫ শতাংশ এবং মৃত্যু সংখ্যা ১৫ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছি তারা।
‘পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের হাসপাতালগুলোতে গত একমাসে বেড়েছে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত রোগী থাকায় কোনো কোনো হাসপাতাল নতুন রোগী ভর্তি করা বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক হাসপাতালে পর্যাপ্ত শয্যা, স্বাস্থ্যকর্মী ও মেডিকেল অক্সিজেনের মজুত না থাকায় মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল শাখার পরিচালক ডা. আহমেদ আল মান্ধারি এক বিবৃতি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনের প্রভাবে ভূমধ্যসাগর উপকূলের এশীয় দেশসমূহসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিদিন বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত রোগী ও এ রোগে মৃতের সংখ্যা। আমরা এখন করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের মধ্যে আছি।’
দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা কাটিয়ে ওঠার মধ্যেই তৃতীয় ঢেউ রুখতে আগাম প্রস্তুতি শুরু করেছে ভারত। এরই মধ্যে করোনার ডেল্টা রূপের প্রভাবে পশ্চিম এশিয়ার চতুর্থ ঢেউ উদ্বেগ বাড়িয়েছে। তবে ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, টিকাকরণের ক্ষেত্রে গাফিলতিই পশ্চিম এশিয়ার এই চতুর্থ ঢেউয়ের কারণ। তাদের কথায়, করোনার টিকা সংগ্রহ আর মজুত করার ক্ষেত্রে এই দেশগুলি যতটা আগ্রহ দেখিয়েছে ততটা টিকাকরণে দেখায়নি। পশ্চিম এশিয়ায় ৪ কোটি ১০ লক্ষ মানুষের টিকাকরণ হয়েছে। যা মোট জনসংখ্যার মাত্র সাড়ে পাঁচ শতাংশ।
টিকার ডোজ সম্পূর্ণ করা ব্যক্তিদের ৪০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যের উন্নত দেশসমূহের নাগরিক। শতকরা হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের উন্নত দেশসমূহের মোট জনসংখ্যা ওই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ।
মধ্যপ্রাচ্যে টিকাদান কর্মসূচি আরও ব্যাপক হওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে ডব্লিউএইচও’র পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নতির আশা কম।’
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দেওয়া এক বিবৃতিতে জানা যায়, করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক পরিবর্তিত ধরন ভারতীয় ডেল্টা ১২৪ টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
এসময় আরও বলা হয়, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই বিশ্বের প্রাধান্য বিস্তারকারী ধরন হয়ে উঠবে ডেল্টা এবং বর্তমানে যে গতিতে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে তাতে আগামী ২ অথবা তিন সপ্তাহের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ২০ কোটিরও বেশি মানুষের করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক এই ধরনটিতে আক্রান্ত হওয়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে।
ডেল্টার প্রভাবে বিশ্বজুড়েই বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। তবে সম্প্রতি এর প্রকোপ বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে ইউরোপ ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। মৃত্যুর হার কমে আসায় পাশ্চাত্যের কিছু দেশ বিধিনিষেধ শিথিল করেছে, কিন্তু জনস্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিধিনিষেধ শিথিলের ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে সেইসব মানুষ, যারা এখনও করোনা টিকা নেননি।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতে প্রথম শনাক্ত হয় ডেল্টা ধরন। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, দেশটিতে চলতি বছর মার্চ থেকে শুরু হওয়া করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে যে বিপুল পরিমাণ আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তার জন্য প্রধানত দায়ী ডেল্টা। এদিকে, গত বছর ভারতে শনাক্ত হওয়ার পর অতি দ্রুত তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বৃটেনে সম্প্রতি করোনা সংক্রমণে উলম্ফন দেখা দিয়েছে এবং দেশটির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ডেল্টা ধরনের প্রভাবেই এই উলম্ফন ঘটেছে।
জলবসন্তের মতো ছড়ায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) একটি অভ্যন্তরীণ নথিতে বলা হয়েছে, জলবসন্তের মতো সহজে ছড়ায় করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এটি অন্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে রোগীর আরও কঠিন জটিলতার সৃষ্টি করছে।
সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সিডিসি’র একটি প্রেজেন্টেশনে বলা হয়েছে, ভ্যাকসিন নিয়েছেন এ রকম মানুষও ভ্যাকসিন না নেওয়াদের মতো একইভাবে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে দিতে পারেন। যিনি ভ্যাকসিন নিয়েছেন তিনি ভাইরাসটি দ্বারা সংক্রামিত হলে তার শরীরে যে পরিমাণ ভাইরাস থাকে একই পরিমাণ ভাইরাস ভ্যাকসিন না নেওয়া আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরেও দেখা যায়।’
এতে বলা হয়, এ ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর আশঙ্কা ১০ শতাংশ কমিয়ে আনে ভ্যাকসিন। এছাড়া ভ্যাকসিন ৯০ শতাংশেরও বেশি কঠিন অসুস্থতাকে প্রতিহত করতে পারে। আর সংক্রমণের ঝুঁকি তিন শতাংশ কমিয়ে দেয়। তাই করোনার ভ্যাকসিন নেওয়া মানুষ এ রোগ থেকে তুলনামূলক বেশি নিরাপদ। তবে এটি সংক্রমণ ঠেকানোর ক্ষেত্রে কম কার্যকর।
সিডিসির পরিচালক রোশেলি ওয়ালেনস্কি বলেন, করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সবচেয়ে বেশি সংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে একটি। এটি জলবসন্ত ও হামের মতোই দ্রুত ও সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভ্যাকসিন নেওয়া মানুষদেরও এ ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি হচ্ছে। এজন্য সবাইকে সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকতে হবে। এই রোগ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত একজন মানুষ গড়ে আরও আট থেকে নয়জনকে সংক্রামিত করতে পারে। সংক্রমণ ঘটানোর হারের একক হিসেবে ধরা হয় ‘আর জিরো’কে। ৮ বা ৯ মানের ‘আর জিরো’ সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন রোগের সংখ্যা খুব বেশি নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৫
আপনার মতামত জানানঃ