করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত গোটা পৃথিবী। বিশ্বব্যাপী মনোযোগ কেড়ে নেওয়া এই মহামারিতে প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। বিশ্ব যখন একটি অতিমারিতে জর্জরিত, বাংলাদেশের পরিস্থিতিও ভালো নয়। প্রতিদিন করোনা ভাঙছে নতুন রোগী শনাক্ত বা মৃত্যুর রেকর্ড।এই মহামারি করোনার মাঝেও নীরবে চলছে আরেকটি মহামারি— হেপাটাইটিস।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসজনিত লিভার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে প্রায় ২০ হাজার মানুষ। আর এ সংখ্যা দেশে এ পর্যন্ত করোনায় যতজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। আর কোভিড অতিমারিতে যখন বিঘ্নিত হচ্ছে নন-কভিড স্বাস্থ্যসেবা, তখন এই সংখ্যা যে বাড়ছে তা বলাই বাহুল্য।
আজ (২৮ জুলাই) বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষে এসব তথ্য জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরামর্শক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশনের অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল।
তিনি জানান, প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ মানুষের শরীরে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের সংক্রমণ আছে আর হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসে সংক্রমিত আরো প্রায় ১ শতাংশের কাছাকাছি। এখানেই শেষ নয়, এ দেশের আরো প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ তাদের জীবদ্দশায় কোনো এক সময় হেপাটাইটিস ভাইরাসে এক্সপোজড হয়েছে। আর এসব মানুষের অনেকেই কোনো এক সময় লিভার সিরোসিস বা এমনকি লিভার ক্যান্সারেও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
এ দেশে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোর মেডিসিন বিভাগগুলোতে প্রতিবছর যত রোগী ভর্তি হয় তার প্রায় ১২ শতাংশ ভুগছে লিভার রোগে। আর যারা মারা যাচ্ছে, হিসাব করলে দেখা যাবে সেখানেও লিভারের রোগগুলো আছে একেবারে ওপরের দিকে। বৈজ্ঞানিক প্রকাশনাগুলো থেকেই দেখা যাচ্ছে, এ দেশের ৮০ শতাংশ লিভার সিরোসিস আর লিভার ক্যান্সার হচ্ছে এই দুটি ঘাতক ভাইরাসের কারণেই।
জানা গেছে, বিশ্ব জুড়ে ৩২৫ মিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’তে আক্রান্ত। ফলে প্রতি বছর ১৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় এ দুই ভাইরাসের কারণে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এইচসিভির সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।
নারীর চেয়ে পুরুষের আক্রান্তের হার দ্বিগুণ
হেপাটাইটিস নিয়ে কাজ করা দেশের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হেপাটোলজি সোসাইটির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী প্রায় ১ কোটি। তাদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে সংক্রমিত প্রায় ৮৫ লাখ। এর মধ্যে ৬ দশমিক ৩ শতাংশই ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী। এ ছাড়া ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আক্রান্তের হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ২ হাজার ৭১৩ জনের ওপর গবেষণা করে এই তথ্য পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
গবেষণায় দেখা গেছে, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৫৭ লাখ পুরুষ ও ২৮ লাখ নারী। শহরে আক্রান্তের হার বেশি।
হেপাটোলজি সোসাইটি জানিয়েছে, হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৬০ শতাংশের বয়স ৩০ থেকে ৪৫ বছর। নানা অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে যাওয়া ৩০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেশি।
আজ বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস
বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস আজ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ২০০৮ সালের ২৮ জুলাই ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স’ বিশ্ববাসীকে সচেতন করতে হেপাটাইটিস দিবস পালনের উদ্যোগ নেয়। এরপর থেকে প্রতিবছর ২৮ জুলাই দিবসটি পালন করা হচ্ছে। ২০১১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দিবসটির স্বীকৃতি দেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে- দূষিত রক্ত, সিরিঞ্জ, মা থেকে সন্তানের দেহে এবং অনৈতিক মেলামেশার কারণে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তারা। দিবসটি উপলক্ষে লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ হেপাটোলজি সোসাইটি এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অব দ্য লিভার বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসজনিত লিভার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে প্রায় ২০ হাজার মানুষ। আর এ সংখ্যা দেশে এ পর্যন্ত করোনায় যতজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। আর কোভিড অতিমারিতে যখন বিঘ্নিত হচ্ছে নন-কভিড স্বাস্থ্যসেবা, তখন এই সংখ্যা যে বাড়ছে তা বলাই বাহুল্য।
হেপাটাইটিস দিবস ২০২১ -এর থিম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘হেপাটাইটিস কান্ট ওয়েট’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাইরাস ঘটিত হেপাটাইটিস নির্মূলকরণের লক্ষ্য কর্মসূচিকে (২০৩০) সফল করতে এই দিবসের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে (যে কর্মসূচির ফলে নতুন সংক্রমণ ৯০% ও মৃত্যু ৬৫% কমে গিয়েছে)।
নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের আবিষ্কার করেন, এই রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করেন এবং টিকাকরণ শুরু করেন। চিকিৎসাবিদ্যায় তার এই অবদানকে স্বীকৃতি জানাতে ২৮ জুলাই তার জন্মদিনে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালন করা হয়।
এদিকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে অন্যান্যবারের মতো এ বছর দিবসটি পালনে ব্যাপক আয়োজন না থাকলেও বিভিন্ন সংস্থার ভার্চুয়াল সভা-সেমিনারের কর্মসূচি রয়েছে।
হেপাটাইটিস কী?
হেপাটাইটিস হলো যকৃতের এক প্রকার প্রদাহ। দু’প্রকারের হেপাটাইটিস রয়েছে— তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী। দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বেড়ে গেলে, পরবর্তীকালে তা থেকে লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সার হতে পারে। পাঁচ প্রকারের হেপাটাইটিস ভাইরাস হয়— হেপাটাইটিস এ ভাইরাস (এইচএভি), হেপাটাইটিস বি ভাইরাস (এইচবিভি), হেপাটাইটিস সি ভাইরাস (এইচসিভি), হেপাটাইটিস ডি ভাইরাস (এইচডিভি) এবং হেপাটাইটিস ইভাইরাস (এইচইভি), সারা বিশ্ব জুড়ে হেপাটাইটিসের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো এই ভাইরাসগুলো।
এই হেপাটাইটিস বি এবং সি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ তৈরি করে, দীর্ঘ সময় কখনো কখনো বছর বা দশক ধরে এর কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় না এবং তারপরে এটাই লিভার ক্যান্সারের মূল কারণে পরিণত হয়। সর্বজনীন স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্তির প্রেক্ষাপটে বলা যেতে পারে, হেপাটাইটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎসার ফলে হেপাটাইটিস বি এবং সি’র কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যু হ্রাস পাবে।
হেপাটাইটিস বি এবং সি একসঙ্গে মৃত্যুর সর্বাধিক সাধারণ কারণ হিসাবে পরিচিত, প্রতি বছর ১.৩ মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন সময়ে, ভাইরাল হেপাটাইটিসের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কাদের বেশি?
হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাস সংক্রমিত মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশু। ড্রাগ সেবনকারী যারা ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ করে। বিপরীত বা একই লিঙ্গের সঙ্গে অনিরাপদ যৌন মিলনকারীদের বা বহুগামী লোকদের মাধ্যমে। কিডনি ডায়ালিসিসের রোগীদের। হিমোফিলিয়া বা রক্ত রোগজনিত রোগী যাদের রক্ত গ্রহণ করতে হয় বারবার। পরীক্ষা ছাড়া রক্ত গ্রহণকারী। জীবাণুমুক্ত না করে সার্জিক্যাল বা ডেন্টাল অস্ত্রোপাচার করলে।
হেপাটাইটিসের লক্ষণ
শরীরের কোনো লক্ষণ ছাড়াই যেমন হেপাটাইটিস হতে পারে আবার জন্ডিস বা চোখ, শরীর বা প্রস্রাব হলুদ হয়ে যেতে পারে, তাছাড়া হঠাৎ বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, দুর্বলতা, ক্লান্তি বোধ করা, খাবারে অরুচি, অনীহা কিংবা তীব্র দুর্বলতা। শরীরে চুলকানি, কখনও জ্বরজ্বর ভাব বা জ্বরের মাধ্যমে সূত্রপাত হতে পারে। এমনকি পায়ে বা পেটে পানি চলে আসতে পারে । এ ছাড়া তীব্রভাবে আক্রান্ত হয়ে রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।
চিকিৎসা
হেপাটাইটিসের লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া উচিত যে এটা হেপাটাইটিসের লক্ষণ কি-না? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হেপাটাইটিস শনাক্ত করে এর কারণ জেনে চিকিৎসা শুরু করলে লিভারের বিকলতা বা মৃত্যুর হাত থেকে বা আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
প্রতিরোধের উপায়
টিকা দেওয়ার মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। চার ডোজ টিকা নিতে হয়। সরকার অবশ্য ২০১০ সাল থেকে দেশের সব শিশুকে এ টিকা দিচ্ছে। কিন্তু এর আগে জন্মগ্রহণকারীদের কিন্তু এ টিকা দেওয়া হয়নি। তাই দেরি না করে টিকা দিন। তবে টিকা দেওয়ার আগে এইচবিএসএজি পরীক্ষা করে দেখুন। যদি এর মান নেগেটিভ থাকে তাহলে আর দেরি নয় টিকা নিন।
রক্ত গ্রহণের আগে অবশ্যই পরীক্ষা করে নিতে হবে যে এই রক্ত ভাইরাসমুক্ত। ডিসপসেবল সুচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে।
হেপাটাইটিস ‘বি’ পজিটিভ মায়ের শিশু জন্মের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাকে টিকা ও অ্যান্টিবডি দিতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে।
ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক বা আচরণ পরিহার করতে হবে।
ব্যক্তিগত ব্যবহার করা ট্রুথব্রাশ, রেজর, নেইল কাটার ইত্যাদি অন্যকে ব্যবহারে নিষেধ করতে হবে।
সেলুন, বিউটি পার্লারে নাক, কান ফোঁড়ানোর সময় বা চুল কাটার সময়, শেভ করা জীবাণুমুক্ত জিনিসপত্র ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
বাচ্চাদের হেপাটাইটিস ‘এ’ ভাইরাসের টিকা দিতে হবে।
বিশুদ্ধ পানি ও খাবার গ্রহণ করতে হবে।
মদ্যপান ও অন্যান্য নেশা জাতীয় দ্রব্য পরিহার করতে হবে।
শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।
ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
চর্বিযুক্ত খাবার কম খেতে হবে। আর শাকসবজি ও ফলমূল বেশি খেতে হবে এবং তা অবশ্যই হতে হবে ফরমালিনমুক্ত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ