করোনা মহামারির কারণে চলমান লকডাউনে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও দেশে এবারের ঈদ-যাতায়াতে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। পবিত্র ঈদুল আজহার আগে-পরে ১১ দিনে (১৪-২৪ জুলাই) দেশে ১৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২০৭ জন এবং আহত হয়েছেন ৩৮৯ জন। নিহতের মধ্যে নারী ২৯ জন এবং শিশু ১৭ জন।
আজ সোমবার (২৬ জুলাই) রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে। গত ১৪-২৪ জুলাই সময়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। সংগঠনটি ৭টি জাতীয় দৈনিক, ৫টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ১১ দিনে ৭৬টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৮৭ জন, যা মোট নিহতের ৪২.০২ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৮.১০ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৪৩ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২০.৭৭ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৩২ জন, অর্থাৎ ১৫.৪৫ শতাংশ। এ সময়ে চারটি নৌ দুর্ঘটনায় ২ জন নিহত ও ২৬ জন আহত হয়েছে। দুটি রেলপথ দুর্ঘটনায় ২ জন নিহত হয়েছে।
প্রতিবেদনে দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ৮৭ জন, বাস যাত্রী ১২ জন, ট্রাক-পিকআপ যাত্রী ৮ জন, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার যাত্রী ১৩ জন, থ্রি-হুইলার যাত্রী (সিএনজি-ইজিবাইক-অটোরিকশা-লেগুনা) ৩১ জন, নসিমন-মাহিন্দ্র-চান্দেরগাড়ি যাত্রী ১০ জন, বাইসাইকেল আরোহী ৩ জন নিহত হয়েছেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৫৯টি জাতীয় মহাসড়কে, ৬৬টি আঞ্চলিক সড়কে, ১৪টি গ্রামীণ সড়কে এবং ১৯টি শহরের সড়কে সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ৪৬টি মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৫৪টি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ৪২টি পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেওয়া এবং ১৬টি যানবাহনের পেছনে আঘাত করার কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনার বিভাগভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে ২০.৮৮ শতাংশ; প্রাণহানি ২৩.১৮ শতাংশ। রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ২৪.০৫ শতাংশ; প্রাণহানি ১৭.৩৯ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৩.২৯ শতাংশ; প্রাণহানি ১৪ শতাংশ। খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১১.৩৯ শতাংশ; প্রাণহানি ১৩.৫২ শতাংশ।
বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৫.৬৯ শতাংশ; প্রাণহানি ৫.৭৯ শতাংশ। সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ২.৫৩ শতাংশ; প্রাণহানি ১.৯৩ শতাংশ।
রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৮.২২ শতাংশ ও প্রাণহানি ১৪.৪৯ শতাংশ। ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ১৩.৯২ শতাংশ; প্রাণহানি ৯.৬৬ শতাংশ ঘটেছে।
প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার ১০টি প্রধান কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে— ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; বেপরোয়া গতি; চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
সংগঠনটি ১০ দফা সুপারিশও জানিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে। সুপারিশগুলো হচ্ছে— দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বাড়াতে হবে; চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; বিআরটিএ’র সক্ষমতা বাড়াতে হবে; পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে; পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবতা হচ্ছে সড়কে প্রাণ যাওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না। সরকারের নানা বিভাগ, একেকজন একেক দিকে। কেউ সঠিক ভাবনা ভাবছে না। তাই যা হবার তাই হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুই যেন আমাদের নিয়তি হয়ে উঠছে। সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া চালক ও বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে আনা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা পরাবে কে?
তারা বলেন, দিনের পর দিন এ অবস্থা তো চলতে পারে না। এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র মুখ বন্ধ করে থাকতে পারে না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সড়ক দুর্ঘটনার মূল অনুষঙ্গ বেপরোয়া গতি। চালকেরা বেপরোয়া গতিতে এবং একের পর এক পাল্লা দিয়ে যান চালানোর কারণেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে।
তারা বলেন, মহাসড়কে গড়ে প্রতি মিনিট পরপর একটি গাড়ি আরেকটি গাড়িকে ওভারটেকিংএর চেষ্টা করে। একটি গাড়ি আরেকটি গাড়িকে পাশ কাটাতে গেলেই দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়। এটি প্রতিরোধে মহাসড়কে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। সড়কে শৃঙ্খলা নেই বলেই দুর্ঘটনা। আর সরকারের পক্ষ থেকে শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগও খুব একটা চোখে পড়ে না। সড়ক নিরাপত্তা শুধু মুখেমুখেই। বাস্তবে কর্মসূচি নেই বললেই চলে।
তারা বলেন, আইন না মানাই হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ। এ ক্ষেত্রে সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশসহ চলমান প্রশাসন এ আইন প্রয়োগে ব্যর্থ হলে প্রয়োজনে তাদের ঢেলে সাজাতে হবে, অন্যথায় নতুন করে দুর্ঘটনা রোধে বিশেষ বাহিনী গঠন করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৪
আপনার মতামত জানানঃ