মহামারি বারবারই বিপর্যস্ত করেছে বিশ্বকে। যার মধ্যে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক মহামারিগুলোর মধ্যে একটি ছিল ব্ল্যাক ডেথ; যা প্লেগ নামেও পরিচিত। মূলত ব্ল্যাক ডেথ বলা হয় মধ্যযুগে ইউরোপের মহামারি প্লেগ রোগকে।
এটি পশ্চিম ইউরোপে ১৩৪৬ সালে শুরু হয়। ইংল্যান্ডে এর প্রকোপ শুরু হয় ১৩৪৮ সালে। ১৩৫০ দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত প্রায় পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে চলতে থাকে এই ভয়াবহ মহামারি।
এই মহামারীর কবলে পড়ে ১৪’শ শতাব্দীতে বিশ্বের জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন থেকে ৩৫০-৩৭৫ মিলিয়নে নেমে আসে। ১৭’শ শতক পর্যন্ত প্লেগ পরবর্তী সময়েও এই সংখ্যা আর পুনরুদ্ধার হয়নি। এমনকি ১৯’ শতকেও এটি ইউরোপের কিছু কিছু জায়গায় দেখা গিয়েছিল।
ইতিহাসে যত মহামারি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাওয়ার রেকর্ড এই ব্ল্যাক ডেথের জন্যই। তার চেয়েও ভয়ানক ব্যাপার ছিল এই রোগটা কেন হচ্ছিল তার কারণ কেউ ধরতে পারেনি তখন।
মধ্যযুগে মানুষ মনে করত, প্লেগ রোগটি দূষিত বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। ‘জার্ম থিওরি’ বা জীবাণু তত্ত্ব আবিষ্কারের আগে চিকিৎসাবিদ্যায় একে বলা হতো ‘মায়াজমা তত্ত্ব’। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় ‘মায়াজমা’ শব্দের অর্থ ছিল দূষণ বা খারাপ বাতাস।
উনবিংশ শতকের শেষের দিকে জানা যায়, প্লেগ রোগের জন্য দায়ী জীবাণুটি হচ্ছে Yersinia pestis নামের ব্যাকটেরিয়া। এটি মাছি আর উকুনের মাধ্যমে মানুষের শরীরে পৌঁছায়। তবে পূর্বে ইঁদুরকে দায়ী করা হতো এই জীবাণু বহনের জন্য।
সেই ব্ল্যাক ডেথ কেন হয়েছ সেই বিতর্ক আবার উসকে দিল নতুন এক আবিষ্কার। লাটভিয়ায় আবিষ্কৃত এক দেহাবশেষকে ধারণা করা হচ্ছে, সবচেয়ে প্রাচীন রোগী অর্থাৎ ‘পেশেন্ট জিরো’।
লাটভিয়ায় আবিষ্কৃত এই দেহাবশেষটি ৫ হাজার বছরের পুরনো। নতুন এ আবিষ্কার থেকে জানা গেছে, এই ব্যক্তিই প্লেগের সবচেয়ে প্রাচীন স্ট্রেইনে আক্রান্ত ব্যক্তি। চতুর্দশ শতকে গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল প্লেগ। এরপরের কয়েক শতাব্দীতে নিয়মিত হানা দিতে থাকে প্লেগ। এতে প্রাণ হারায় লাখ লাখ মানুষ।
এই ৫ হাজার ৩০০ বছরের প্রাচীন দেহাবশেষটি সম্পর্কে জার্মানির কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. বেন ক্রস-কিয়োরা বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত যতগুলো প্লেগ আক্রান্ত দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে এটিই সবচেয়ে প্রাচীন’।
লাটভিয়ার স্যালাক নদীর তীরের একটি নিওলিথিক সমাধিস্থলে আরও তিনজনের সঙ্গে কবর দেওয়া হয়েছিল এই ব্যক্তিকে।
এই চারটি দেহাবশেষের হাড় ও দাঁতের ডিএনএ বিন্যাস বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, এদের একজন ছিল শিকারি-সংগ্রাহক। বয়স বিশের কোঠায়। ব্যাকটেরিয়া সৃষ্ট প্লেগের প্রাচীন স্ট্রেইন ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস-এ আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল সে।
গবেষকের মতে, এই যুবক খুব সম্ভব কোনো বীভারের কামড় খেয়েছিল। সেখান থেকেই তার ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস সংক্রমণ হয় এবং এর ফলে সৃষ্ট পচন থেকে দুই থেকে সাত দিন পর মারা যায় সে।
ধারণা করা হয়, মধ্য এশিয়ার ইসিক-কুল হ্রদ থেকে প্লেগ রোগটি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় এই অঞ্চলে ১৩৩৮ এবং ১৩৩৯ সালে উচ্চ মৃত্যুহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া কিছু স্মৃতিস্তম্ভও পাওয়া যায় যা প্লেগ রোগকেই নির্দেশ করে।
বিশেষজ্ঞরা তাই মনে করেন, প্লেগ রোগটি এখান থেকেই পূর্ব দিকে চীন এবং দক্ষিণ দিকে ভারতে ছড়িয়েছে। চীন এবং কাস্পিয়ান সাগর অঞ্চলের জন্য এই হ্রদ খুব সহজেই অতিক্রমযোগ্য ছিল। কারণ এই হ্রদটি ঐতিহাসিক সিল্ক রোডের পাশে ছিল। তাই এখানে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রচুর লোকসমাগম হতো।
তবে কিছু সূত্র মতে, প্লেগ ১৩২০ এর দশকে চীনে প্রথম শুরু হয়। সম্ভবত এটি ইসিক-কুল হ্রদে যাওয়ার আগে চীনকে সংক্রমিত করেছিল অথবা এটি ছিল শুধু চীনের মধ্যে সীমাবদ্ধ একটি বিচ্ছিন্ন সংক্রমণ। তবে এই রোগের কারণে চীনেও লাখ লাখ মানুষ মারা যায়।
চীন থেকে বাণিজ্যিক রাস্তার মাধ্যমে রোগটি ভারতেও এসে পৌঁছায়। ভারতেও প্রচুর মানুষ মারা যায় এই রোগে। প্লেগের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি মধ্যপ্রাচ্যও। মক্কাতেও ছড়িয়ে পড়ে এর ভয়াবহতা। সম্ভবত ব্যবসায়ী আর হজ্ব যাত্রীদের কাছ থেকেই এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
১৩৪৭ সালের অক্টোবরে সিসিলির মেসিনা বন্দরে কৃষ্ণ সাগর থেকে ১২টি জাহাজ নোঙর করে। জাহাজের যত নাবিক ছিল, বেশিরভাগই ছিল মৃত। যারা জীবিত ছিল, তারাও ছিল খুব অসুস্থ।
তাদের শরীরে ছিল ফোলা অংশ। এগুলো থেকে রক্ত আর পুঁজ বের হচ্ছিল। মেসিনার কর্তৃপক্ষ যখন বুঝতে পারে এই জাহাজের মাধ্যমে নতুন রোগ চলে এসেছ, তখন তারা জাহাজগুলোকে সরিয়ে দেয় এই অঞ্চল থেকে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
শহরের জনগণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং রোগে আক্রান্তরা পালিয়ে যায় গ্রামে। এতে তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলেও রোগের সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে থাকে। এদিকে সিসিলি যখন মহামারির সংক্রমণে ভুগছিল, সেই জাহাজগুলো নভেম্বরের মধ্যে তাদের প্রতিবেশী দ্বীপ অঞ্চল কর্সিকা ও সার্ডিনিয়াতেও এই রোগ ছড়িয়ে দেয়।
১৩৪৭ সালে এটি শুধু ইতালি ও গ্রিসের কিছু অংশে ছড়ায়। কিন্তু ১৩৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ইউরোপের প্রায় অর্ধেক অঞ্চলই ব্ল্যাক ডেথের সংক্রমণের শিকার হয়। কয়েক মাসের মধ্যেই ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়ে।
১৩৫৩ সালে এটি যখন রাশিয়ায় পৌঁছে দুর্বল হয়ে যায়, ফিনল্যান্ড আর আইসল্যান্ডের মতো অল্প কিছু দেশই এর হাত থেকে রক্ষা পায়। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় এর সংক্রমণ দুর্বল হয়ে যায়। ভয়াবহ এই মহামারিতে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়।
তবে সদ্য আবিষ্কার থেকে গবেষকদের অনুমান, এই প্রাচীন স্ট্রেইনটির আবির্ভাব প্রায় ৭ হাজার বছর আগে। মধ্য ইউরোপে তখন কৃষিকাজের প্রচলন হচ্ছে। তাদের ধারণা, ব্যাকটেরিয়াটি বড় ধরনের কোনো প্রাদুর্ভাব সৃষ্টি না করেই ঘুরতে ঘুরতে প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
সময়ের আবর্তে অভিযোজিত হতে হতে ব্যাকটেরিয়াটি মানুষকে সংক্রমণক্ষম হয়ে ওঠে। বিবর্তিত হতে হতে এটি বিউবনিক প্লেগের সূত্রপাত করে। মাছির মাধ্যমে এই প্লেগ মধ্যযুগে গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ৭৫-২০০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় বিউবনিক প্লেগে।
সাধারণত প্লেগের জীবাণুবাহী অথবা প্লেগে আক্রান্ত কোনো প্রাণীর কামড় খেলে বা সংস্পর্শে এলে মানুষ প্লেগে আক্রান্ত হয়। এ রোগ আজও হয়, তবে এখন তা চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য। মৃতদেহতে ওইসব ভাইরাস মৃত্যুর ২ থেকে ৩ ঘণ্টা পর নষ্ট হয়ে যায় বলে দাবি গবেষকদের। তবে এক্ষেত্রে যদি মৃতদেহ সংরক্ষণ কিংবা সমাধিস্থ করার পর তা প্রাকৃতিক কারণে সংরক্ষিত হয়। সেইক্ষেত্রে ভাইরাস থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ।
এজন্য যেসব অঞ্চলে সারাবছর বরফের নিচে ঢাকা থাকে। সেখানে মানুষকে করব দেয়া হয় না। কেননা সেখানে বরফের কারণে মৃতদেহ পচে না। এমন প্লেগ আক্রান্তদের কবর দেওয়ার শত বছর পরও সেই অঞ্চলে আবার মৃতদেহ থেকে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাও আছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০৩০
আপনার মতামত জানানঃ