ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর বহু দশক ধরে নানা ধরনের উত্তেজনা, মানবিক সংকট এবং কূটনৈতিক চাপের ঘটনা ঘটে চলেছে। সম্প্রতি অনলাইন ও সংবাদমাধ্যমে ‘পুশ-ইন’ নামে পরিচিত একটি বিতর্কিত পদ্ধতির খবর আবারও আলোচনায় এসেছে। ‘পুশ-ইন’ বলতে বোঝায়, অবৈধ অভিবাসনকারীদের বা সন্দেহভাজন বাংলাদেশিদের ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা জোর করে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়ার বা ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া। যদিও ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো এই নীতি স্বীকার করেনি, বিভিন্ন সময়ে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর বাসিন্দা, সংবাদমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো একাধিকবার এ বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করেছে।
বাংলায় কথা বললেই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের বাংলাদেশে জোর করে পাঠিয়ে দিচ্ছে বিএসএফ ও দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার। আজ সোমবার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার অধিবেশনে সীমান্ত সুরক্ষা ও পুশ ব্যাক বিষয়ে বিধায়কদের আনা প্রশ্নের উত্তরে একথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সম্প্রতি মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার বাসিন্দা মেহবুব শেখকে (৩৬) ঠেলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে বিএসএফের উত্তরবঙ্গের শাখা। ওই ব্যক্তি মহারাষ্ট্রের ঠাণেতে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। গত ১১ জুন তাকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।
মেহবুবের ভাই মুজিবুর রহমান জানান, তার বড় ভাইকে গত শুক্রবার ভোর রাতে শিলিগুড়ির বিএসএফ বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করেছে। তিনি আরও জানান, পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্যদের সভাপতি সামিরুল ইসলাম ওই শ্রমিকের দুর্দশার বিষয়টি জানার পর মহারাষ্ট্র পুলিশের যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় নথিপত্র পাঠান। তার মধ্যে মেহবুবের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত বিবরণ ও পঞ্চায়েতের সার্টিফিকেট রয়েছে।
তবে মহারাষ্ট্র পুলিশ ওই সব নথিপত্রকে গুরুত্ব দেয়নি। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের পক্ষেও মহারাষ্ট্র পুলিশকে মেহবুবের ভারতীয় নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল ঠাণেতে। তাতেও কাজ হয়নি।
মেহবুবের ভাই গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা মুম্বাইয়ের ঠাণেতে গেলে মহারাষ্ট্র পুলিশ বলেছে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে আটক মেহবুবসহ আরও কয়েকজনকে তারা শিলগুড়িতে বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করে। শিলিগুড়ির বিএসএফের ইউনিটে তাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। পরে তারা জানতে পারেন, গত শুক্রবার ভোরে মেহবুবসহ আটক সবাইকে ‘পুশ ব্যাক’ করা হয়েছে। যদিও সরকারিভাবে বিএসএফ এবং মহারাষ্ট্র পুলিশ এই বিষয়ে কিছু জানায়নি।
গত এক দেড় মাস ধরে বিএসএফের পুশ ব্যাক চললেও এই বাহিনী সরকারিভাবে কিছু জানাচ্ছে না। অন্যদিকে, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছে, বিএসএফ এমন অনেককে ঠেলে পাঠাচ্ছে যাদের কাছে ভারতীয় হিসেবে নথিপত্র আছে।
এই ‘পুশ-ইন’ কার্যক্রম কেন করা হচ্ছে, তার পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বাংলাদেশি অভিবাসীদের অনুপ্রবেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক বিতর্ক রয়েছে। এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস) এবং সিএএ (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) এর মাধ্যমে এই অভিবাসী সমস্যা ভারতের রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বিজেপি সরকার ও কিছু আঞ্চলিক দল বহুদিন ধরে দাবি করে আসছে যে, বাংলাদেশি অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা ভারতের সংস্কৃতি, নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে হুমকি তৈরি করছে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে সীমান্ত রক্ষীরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে থাকে, অনেক সময় জোর করে, যার ফলেই পুশ-ইনের মতো ঘটনা ঘটে।
দ্বিতীয়ত, কিছু ক্ষেত্রে ভারতের অভ্যন্তরে বসবাসরত দরিদ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকদের বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা হয়। কোনো বৈধ নথিপত্র না থাকা বা ভাষাগত মিলের কারণে তাদের বাংলাদেশি মনে করে সীমান্ত দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় অনেকে বাস্তবিক অর্থে ভারতেই জন্মগ্রহণকারী, কিন্তু তাদের জাতীয়তা প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় তারা উদ্বাস্তুতে পরিণত হন।
তবে এই পুশ-ইনের পদ্ধতি কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণই নয়, এটি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককেও জটিল করে তোলে। বাংলাদেশ সরকার বহুবার অভিযোগ করেছে যে, এই ধরনের পদ্ধতি আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন ও মানবিক মর্যাদার পরিপন্থী। কারণ, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশি কি না, তা যাচাই-বাছাই ছাড়া তাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া আন্তর্জাতিক রীতিনীতির লঙ্ঘন। ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী উভয় দেশকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে সীমান্ত সমস্যা মেটাতে হবে। কিন্তু পুশ-ইনের মতো একতরফা কার্যক্রম সেই চুক্তির অবমাননা বলে মনে করেন অনেক কূটনৈতিক বিশ্লেষক।
এর ফলাফল বাংলাদেশে একাধিক দিক থেকে প্রতিক্রিয়াশীল। প্রথমত, সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হয়, যাতে কোনো অবাঞ্ছিত ব্যক্তি অবৈধভাবে প্রবেশ করতে না পারে। এতে সীমান্তে বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বাড়তি চাপ পড়ে এবং অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত, ভারত থেকে পুশ-ইন হয়ে আসা ব্যক্তিরা অনেক সময়ই কোনো প্রমাণপত্র ছাড়া, সম্পূর্ণ অপরিচিত হিসেবে হাজির হন। ফলে প্রশাসন তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারে না, এবং সমাজে উদ্বেগ তৈরি হয়। তৃতীয়ত, এটি দেশের অভ্যন্তরেও রাজনীতি ও জনমতকে উত্তেজিত করে তোলে, বিশেষত যখন বিষয়টি ধর্মীয় রং পায়।
এই ঘটনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আরও গভীর। এটি দুই দেশের সম্পর্ককে ক্রমাগত অবিশ্বাসের দিকে ঠেলে দেয়। যেখানে ভারত ও বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও পানিবন্টন বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে চেষ্টা করছে, সেখানে এই ধরনের পুশ-ইন কৌশল সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরায়। এতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়, বিশেষ করে যখন সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী সাধারণ জনগণ বারবার নিরাপত্তাহীনতা বোধ করেন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে যে, পুশ-ইন পদ্ধতি ব্যক্তির মৌলিক অধিকার ও আন্তর্জাতিক মানবিক নীতিমালার পরিপন্থী। কেউ যদি সত্যিই অনুপ্রবেশকারী হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে তার পরিচয় যাচাই করে তাকে যথাযথ দেশে ফেরত পাঠানো উচিত। কিন্তু সীমান্তে লোক ঠেলে দেওয়ার কৌশল বর্বরতা এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব থেকে পলায়নের নামান্তর মাত্র।
সব মিলিয়ে, ভারত থেকে বাংলাদেশে পুশ-ইনের মতো ঘটনা একদিকে যেমন সীমান্তবর্তী জনগণের জীবনে অনিশ্চয়তা ও বিপদের ছায়া ফেলছে, তেমনি দুই দেশের সম্পর্কে এক অদৃশ্য চাপ তৈরি করছে। এটি বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দ্বিপাক্ষিক আলোচনা, আন্তর্জাতিক নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধা এবং মানবাধিকারের মূল্যবোধকে সামনে রাখতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে এই সংকট আরও তীব্র হবে এবং যার খেসারত দিতে হবে সাধারণ নিরপরাধ মানুষকে।
আপনার মতামত জানানঃ