সাম্প্রতিক হামলাগুলো ইরানের ওপর ইসরায়েলের সাহসী আক্রমণের প্রমাণ হলেও, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে—ইসরায়েল হয়তো ইরানের সামরিক শক্তিকে ভুলভাবে মূল্যায়ন করেছে। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ভেদ করে আঘাত হেনেছে, আর নেতৃত্বে বড় ক্ষতি সত্ত্বেও ইরানি কমান্ড দ্রুতই নিজেদের সংগঠিত করেছে। এখন অনেকেই মনে করছেন, ইসরায়েলের ‘রেজিম পরিবর্তনের’ লক্ষ্যটি ছিল একটি কৌশলগত ভুল অনুমান। তদুপরি, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে এই সংঘাতে টেনে আনতে চাইলেও, মার্কিন প্রশাসন চাইছে যেন সংঘাতটি এখানেই শেষ হয়।
সবদিক বিবেচনায়, ইসরায়েলের সাম্প্রতিক আক্রমণ—যার মধ্যে রয়েছে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর বিমান হামলা এবং শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে হত্যাকাণ্ড—তাদের সবচেয়ে আক্রমণাত্মক কৌশলের পরিচায়ক। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, ইরানকে দুর্বল করে কোনো সমঝোতার দিকে ঠেলে দেওয়ার ধারণাটি বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। বরং প্রতিপক্ষ হিসেবে এক সুসংগঠিত ও কঠিন প্রতিরোধের চিত্রই সামনে আসছে। ইসরায়েল হয়তো ইরানের প্রতিরক্ষা কাঠামো, সামরিক প্রস্তুতি এবং ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতার ব্যাপারে ভুল করে ফেলেছে।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত থেমে নেই। উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে, একে অপরকে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় জর্জরিত করছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল হয়তো ইরানকে এককভাবে দমন করতে পারবে না—এমন কৌশলগত ভুল তারা করে ফেলেছে।
কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফট-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসি সিএনএন-কে বলেন, “তারা (ইসরায়েল) ভেবেছিল, ইরানের সামরিক নেতৃত্বের ওপর সফল আঘাত হেনে তারা কমান্ড সিস্টেমকে ভেঙে দিয়েছে।” কিন্তু বাস্তবে খুব দ্রুতই সে কমান্ড আবার পুনর্গঠিত হয়েছে। পারসি আরও বলেন, “এখন দেখা যাচ্ছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তর ভেদ করে প্রবেশ করছে।”
ইসরায়েলের আকাশশক্তির সীমাবদ্ধতা
ইসরায়েল যখন ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনাতে হামলা চালায়, তখন তা অনেকের কাছে বড় কৌশলগত সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে, এই হামলার প্রভাব খুব সীমিত ছিল। কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ—যেমন মাটির নিচে সুরক্ষিতভাবে থাকা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কক্ষ—প্রায় অক্ষত রয়ে গেছে। ফোর্ডো স্থাপনাটি, যা পাহাড়ের গভীরে অবস্থিত ও আরও সুরক্ষিত, একেবারেই ছোঁয়া যায়নি। গোয়েন্দা বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, এ ধরনের ঘাঁটি ধ্বংস করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত ‘বানকার বাস্টার’ বোমা ও বি-২ স্টেলথ বোমার বিমানের মতো সরঞ্জামের দরকার হবে। ইসরায়েলের উন্নত যুদ্ধবিমান থাকলেও, এসব পারমাণবিক স্থাপনায় স্থায়ী ক্ষতি করার মতো ক্ষমতা তাদের নেই।
ফিনান্সিয়াল টাইমস–এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ স্টেলথ বোমার বিমানে ৩০,০০০ পাউন্ড ওজনের ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনেট্রেটর’ রয়েছে, যেটা এমন ধরনের ঘাঁটি ধ্বংসের জন্যই তৈরি। কিন্তু ইসরায়েল যদি একা অভিযান চালায়, তাহলে তাদের বিকল্প সীমিত।”
ইসরায়েলের এফ-১৫ যুদ্ধবিমানগুলো ৪,০০০ থেকে ৫,০০০ পাউন্ড ওজনের জিবিইউ-২৮ বোমা বহন করতে পারে, যেগুলো ৫-৬ মিটার কংক্রিট ভেদ করতে সক্ষম। ইসরায়েলের কাছে কিছুসংখ্যক এমন বোমা আছে, তবে কতগুলো আছে তা গোপন রাখা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে এসব বোমা নেই যেগুলো দিয়ে পুরো পরমাণু স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা সম্ভব।
প্রাক্তন মার্কিন বিমান বাহিনীর জেনারেল চার্লস ওয়াল্ড—বর্তমানে জিউইশ ইনস্টিটিউট ফর দ্য ন্যাশনাল সিকিউরিটি অফ আমেরিকা-তে যুক্ত—এপ্রিল মাসে বলেছিলেন, “তাদের কাছে ফোর্ডো এবং নাতাঞ্জ ধ্বংসের মতো পর্যাপ্ত ৫,০০০ পাউন্ড ওজনের বোমা নেই।”
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সামরিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ম্যাথিউ স্যাভিল বলেন, “তারা ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে পারবে, কিন্তু একা পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারবে এমনটা সন্দেহজনক। তবে তারা সময় নিয়ে বারবার আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত।”
এই সামরিক সীমাবদ্ধতা ইসরায়েলের হামলার কৌশলগত হিসাব-নিকাশের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। যদি মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে বিলম্বিত বা ধ্বংস করা, তাহলে বাস্তবতা বলছে, এই অভিযানের মাধ্যমে সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। বরং ইরান তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত করেছে, যা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে সীমিত বিমান হামলার মাধ্যমে এখন আর ইরানকে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। ইসরায়েলের হামলার পরিণতিতে ইরান এমন একটি বিল আনছে যা তাদের পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি (NPT) থেকে সরে যাওয়ার পথে এগিয়ে নিতে পারে। এই ঘোষণার সময়টাও খুব তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ ইসরায়েল দাবি করছে, ইরান নাকি পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ভাঙন: এক কৌশলগত চমক
ইসরায়েলের সামরিক পরিকল্পনাকারীদের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হচ্ছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলের বহুপদক্ষেপের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা—যেমন আয়রন ডোম, ডেভিড’স স্লিং এবং অ্যারো সিস্টেম—পেরিয়ে আঘাত হেনেছে। যদিও ইসরায়েল অনেকগুলো ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু কিছু ক্ষেপণাস্ত্র সফলভাবে আঘাত হানে এবং তা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে।
ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড দাবি করেছে যে তারা এমন একটি নতুন পদ্ধতিতে আক্রমণ চালিয়েছে যা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিজেরাই একে অপরকে টার্গেট করেছে এমন বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। তাদের ভাষ্যমতে, “আমেরিকা ও পশ্চিমাদের সর্বাত্মক সহায়তা এবং সবচেয়ে আধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি থাকার পরও আমাদের উদ্যোগ ও সক্ষমতা দখলকৃত ভূখণ্ডে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সর্বোচ্চ ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত নিশ্চিত করেছে।”
ইরানের পাল্টা আক্রমণের ফলে ইসরায়েলকে এখন অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে এক অনিশ্চিত খরচের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যা ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ক্ষয়ক্ষতির দৃশ্যেই প্রকাশ পাচ্ছে।
কমান্ড কাঠামোর দ্রুত পুনর্গঠন
ইসরায়েল সম্ভবত ইরানের প্রাতিষ্ঠানিক সহনশীলতাকেও হালকাভাবে নিয়েছিল। বেশ কয়েকজন শীর্ষ ইরানি সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করার পর ইসরায়েল ধারণা করেছিল যে এতে তেহরানের সামরিক কাঠামো ভেঙে পড়বে। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো: ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী খুব দ্রুত তাদের কমান্ড কাঠামো পুনর্গঠন করে ফেলেছে। এই বাহিনী বহুদিন ধরেই এমনভাবেই গঠিত হয়েছে যাতে নেতৃস্থানীয়দের হত্যায় তারা ভেঙে না পড়ে, বরং তা সামলে নিতে পারে।
এই দৃষ্টান্ত ইসরায়েলের কৌশলের কেন্দ্রে থাকা একটি ভুল ধারণা প্রকাশ করে—এটা ভাবা যে কয়েকজন ব্যক্তিকে সরালেই পুরো সামরিক কার্যক্ষমতা ভেঙে পড়বে। আসলে, আইআরজিসি (IRGC) একটি গভীরভাবে প্রোথিত, আদর্শিকভাবে চালিত এবং অপারেশনালি বিভক্ত সংগঠন—এমন কাঠামো যা নেতৃত্বহীনতা সামলাতে দক্ষ।
ইসরায়েল কি ইরানের সরকার পতনের চেষ্টা করছে?
যদিও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে কখনও বলেননি যে তারা ইরানে সরকার পরিবর্তন চায়, তবে সাম্প্রতিক হামলার স্কেল ও শীর্ষ নেতৃত্বকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর ধরন থেকে অনেকেই মনে করছেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট করাই গোপন লক্ষ্য। রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানা গেছে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একবার ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হত্যার একটি ইসরায়েলি পরিকল্পনা আটকে দিয়েছিলেন।
যদি সত্যি ইসরায়েল সরকার পতনকে তাদের লক্ষ্য বানিয়ে থাকে, তাহলে এটি হবে এক গুরুতর কৌশলগত ভুল। মধ্যপ্রাচ্যের আর কোনও সরকার এত চাপ, নিষেধাজ্ঞা, একঘরে করে রাখা ও যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে এতদিন টিকে থাকতে পারেনি, যতটা ইরান পেরেছে। ইরান-ইরাক যুদ্ধ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত—এই সরকার তাদের রাজনীতি ও সামরিক কাঠামো এমনভাবে গড়ে তুলেছে, যা সহজে ভেঙে পড়ে না।
ইতিহাস বলে, বিমান হামলা দিয়ে সরকার পরিবর্তন সম্ভব না। সার্বিয়া থেকে লিবিয়া পর্যন্ত, শক্ত সরকারকে সরাতে হয় বিশাল মাটির সেনা অভিযান অথবা অভ্যন্তরীণ বিপ্লব—যার কোনোটিই এখন ইসরায়েলের নাগালে নেই। যদি ইসরায়েল ভেবে থাকে, শুধু আকাশপথে আক্রমণ চালিয়ে জনবিক্ষোভ বা নেতৃত্বে ভাঙন তৈরি করবে, সেটা এখনো কার্যকর প্রমাণ হয়নি।
ইসরায়েল চাইছে আমেরিকাকে টেনে আনতে
সবচেয়ে বড় ইঙ্গিত যে ইসরায়েল একা পেরে উঠছে না, তা হলো তারা এখন যুক্তরাষ্ট্রকে এই সংঘাতে টেনে আনতে চাইছে। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস বা সরকারকে দুর্বল করতে যথেষ্ট সামরিক শক্তি না থাকায়, ইসরায়েল এখন আমেরিকার সরাসরি অংশগ্রহণ চাচ্ছে—খোলাখুলি হোক বা পরোক্ষভাবে।
তবে এই চেষ্টা ঝুঁকিপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও, একই সঙ্গে সংঘর্ষ বিস্তারের ঝুঁকিও তারা অনুধাবন করছে। ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধ হলে, বিশ্ব তেলের বাজার ভেঙে পড়বে, মধ্যপ্রাচ্যে থাকা মার্কিন ঘাঁটিগুলো হুমকির মুখে পড়বে, এবং অন্য শক্তিগুলোও জড়িয়ে পড়তে পারে। এখনো পর্যন্ত স্পষ্ট নয় যে যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের ভয়াবহ সংঘাতে জড়াতে প্রস্তুত কি না।
রবিবার ট্রাম্প ইরান ও ইসরায়েলকে “চুক্তি করার” আহ্বান জানিয়েছেন, তবে বলেছেন সংঘর্ষ চলতেই পারে। সবমিলিয়ে, মনে হচ্ছে আমেরিকা এই সংঘাতের ইতি চায়, তাতে জড়িয়ে পড়া নয়।
ইসরায়েল সাহসী সামরিক অভিযান চালালেও তারা হয়তো ইরানের গভীরতা, টিকে থাকার ক্ষমতা এবং সুপরিকল্পিত প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতাকে ভুলভাবে বিচার করেছে। এই সংঘাত এখন পুরো অঞ্চলে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে আমেরিকা সহ আরও অনেক শক্তিই জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
দ্য ইকোনমিক টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন শুভ্র সরকার।
আপনার মতামত জানানঃ