গত ৬ বছর ধরে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ চলে আসছে। দুর্বল ইয়েমেন সরকার এবং হুতি বিদ্রোহীদের মধ্যে এই সংঘাতের শুরু হয় ২০১৪ সালে। ইয়েমেনে যুদ্ধের কারণে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৪০ হাজার ৮২৪ নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এ তথ্য আলনাদুর খবরমাধ্যমে জানায় ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)।
এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, ১ জানুয়ারি থেকে ৩ জুলাইয়ের মধ্যে ছয় হাজার ৮০৪ পরিবারের ৪০ হাজার ৮২৪ জন কমপক্ষে একবার হলেও বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। শুধু ২৭ জুন থেকে ৩ জুলাইয়ের মধ্যে ৮১ পরিবারের অন্তত এক হাজার ৮৬ ইয়েমেনি বাস্তুচ্যুত হন।
বাস্তুচ্যুতদের অধিকাংশই আল দাহাল, মারিব এবং আল হুদাইদা প্রদেশের। যুদ্ধের পাশাপাশি করোনাভাইরাসের কারণেও বাস্তুচ্যুতির ঘটনা বাড়ছে দেশটিতে।
মানবিক বিষয়সমূহ সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা জাতিসংঘের দপ্তর থেকে জানানো হয়, ইয়েমেনে সংঘাতে এ পর্যন্ত ২ লাখ ৩৩ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ গেছে।
২০১৪ সাল থেকে ইয়েমেনে সহিংসতা এবং বিশৃঙ্খলা লেগে আছে। ২০১৫ সালে যখন সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট আগ্রাসন শুরু করে এর পর থেকে দেশটির পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। এক বছর পর সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়, যখন সৌদি আরব ও আটটি আরব দেশের জোট হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এতে সমর্থন দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিতে অন্যান্য বিষয়ে পরিবর্তনের ঘোষণাও দেন বাইডেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে আরও বেশি সংখ্যক শরণার্থী গ্রহণের সিদ্ধান্তও।
যুক্তরাষ্ট্র কি এড়াতে পারবে এই গৃহযুদ্ধের চাপ?
যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধে জড়ানোর কারণ, ইয়েমেনে গণতন্ত্র উদ্ধারের নামে সৌদি আরবের সঙ্গে সবরকম সম্পর্ক বজায় রাখা। আর কিছু অস্ত্র-বাণিজ্য হলে তো ষোলো আনাই লাভ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এতই ভালো যে, সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দিকে অভিযোগের যে শক্ত তীর নিক্ষেপ হয়েছে তা নিয়ে নিরব ট্রাম্প ছিলো প্রশাসন। সিআইএ’ ররিপোর্টকেও ভিন্নভাবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনা এসেছে।
এছাড়াও সৌদির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে হাজার হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য। বরাবারের মতো মার্কিন সরকার তাদের স্বার্থ দেখবে এটাই ধরে নেয়া স্বাভাবিক। এজন্যও ইয়েমেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ সৌদির সাথে যতই থাকা যায় ততই লাভ। সাপও মরবে না, লাঠিও ভাঙবে না নীতিই অনুসরণ করতে চাইবে যুক্তরাষ্ট্র
এই গৃহযুদ্ধের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ আছে কি না তা নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসির সেন্টার পর ইকোনমিক এন্ড পলিসি রিসার্চার মাক ওয়েজব্রুট সম্প্রতি বলেন, আগে হোক পরে হোক এই আত্মঘাতী যুদ্ধ থেকে সরে আসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ থাকবে। তবে কতজন মারা যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র সেখান থেকে পিছু হটবে তা জানা নেই।
যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের সদস্য এবং কমনওয়েলথ বিষয়ক ছায়া মন্ত্রী ইমিলি থর্নবাড়ি ২০২০ এর ২২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ানে লিখেছিলেন, ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর বেশিরভাগ দায় তিনি সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটকে দিতে চান সেকথাও স্পষ্ট করে বলেছেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, বাণিজ্যিক বন্দর এবং বিমান বন্দরগুলো দখলে রেখেছে হুতি বিদ্রোহীরা। বিশেষ করে হুদাইদা বন্দর দিয়ে সব ধরনের পণ্যের আমদানি রপ্তানি বন্ধ করে রেখেছে বিদ্রোহীরা।
যুদ্ধ চলাকালীন দূর্ভিক্ষ শুরু হবার কারণ
ইয়েমেনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ তাদের জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের আমাদানির জন্য হুদাইদা বন্দরের ওপর নির্ভরশীল। এতে করে খাদ্য-সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। না খেয়ে মরছে মানুষ।
এদিকে, সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট খুব ঠান্ডা মাথায় ও সুকৌশলে ইয়েমেনের নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা, সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন। সেক্ষেত্রে কৃষি জমি-ডেইরি ফার্ম-খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা কিংবা খাবার কেনা-বেচার বাজারগুলো বোমা ফেলে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। বিষয়টি তদন্তের দাবি জানানো হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে ।
বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো যাতে আন্তর্জাতিক জোটের অধীনে চলে আসে সেজন্যই এই কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে বলে যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের সদস্য ইমিলি থর্নবাড়ি জানান। এটা যদি হয়ে থাকে, তাহলে তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে পরিগণিত। এর দায় ইয়েমেন সংকটের জন্য দায়ী সব পক্ষকেই নিতে হবে।
অন্যদিকে, ইয়েমেনের পরিস্থিতি এত দুর্বিষহ যে, বছরে ২ কোটি ৬০ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে বলে জানিয়েছেন দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র নাজিব আল কুব্বাত। প্রতি ৫ মিনিটে মারা যাচ্ছে ১টি করে শিশু। এছাড়া সৌদি জোটের আগ্রাসনের কারণে ইয়েমেনের মোট ৫২৭টি হাসপাতাল সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। দেশের অর্ধেক হাসপাতালে সেবা দেয়ার অবস্থা নেই।
ইয়েমেন পরিস্থিতি আদতে শিয়া-সুন্নি কিংবা ইরান-সৌদি বিরোধের চেয়ে জটিলতর। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা কূটনীতি বুঝতে এই যুদ্ধের মাত্রাগত ভিন্নতার দিকে নজর দিতে হয়। আদৌতে ইয়েমেন সংকট কি আঞ্চলিক সংকট? নাকি বিশ্ব মোড়লেরা এখানে ঘি ঢেলে আঞ্চলিক সমস্যা তৈরি করে ফায়দা লুটছে !
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২০৩৪
আপনার মতামত জানানঃ