করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ স্থানে আছে বাংলাদেশ। এই মুহূর্তে দেশের সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি সবচেয়ে আক্রান্ত দেশ ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ, ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশনের (সিআরআইডিএ) বিশ্লেষণে এসব তথ্য পাওয়া এসেছে।
আজ সোমবার (৫ জুলাই) প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শাহরিয়ার রোজেন গণমাধ্যমকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সিআরআইডিএ জানায়, ১ জুলাইয়ের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সূচক বা রিপ্রোডাকশন রেট হচ্ছে ১.৪১- অর্থাৎ সংক্রমণ প্রতি ১০০০ জন থেকে ১৪১০ জনে ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের উচ্চ রিপ্রোডাকশন রেট ইঙ্গিত করে যে, বাংলাদেশ এখনও সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছায়নি। কিন্তু জনগণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে আগামী দিনগুলোতে সংক্রমণের মাত্রা আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে লকডাউন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে সংক্রমণ ২-৩ সপ্তাহ পর স্থিতিশীল হয়ে আসতে পারে।
সংক্রমণ কত দ্রুত বাড়ছে তা নির্ণয় করার জন্য সারা বিশ্বে “রিপ্রোডাকশন রেট” নামক সূচক ব্যবহার করা হয়। আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটার তথ্য ব্যবহার করে সিআরআইডিএ’র বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সর্বশেষ (১ জুলাই, ২০২১) রিপ্রোডাকশন রেট হচ্ছে ১.৪১, যা বাংলাদেশে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট শনাক্তের প্রথম দিন (অর্থাৎ ৮ মে, ২০২১)-এর তুলনায় ২০০ শতাংশেরও বেশি।
রিপ্রোডাকশন রেট দিয়ে বোঝানো হয় নির্দিষ্ট সময়ে সংক্রমণ কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সহজ ভাষায়, রিপ্রোডাকশন রেট দিয়ে বোঝায়, একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে কত জন মানুষ নতুন করে সংক্রমিত হচ্ছে। রিপ্রোডাকশন রেট ১.০০’র বেশি হলে বুঝতে হবে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আর রিপ্রোডাকশন রেট যদি ১.০০’র কম হয়, তবে বোঝা যায় সংক্রমণ ধীরে ধীরে কমছে।
আফ্রিকান দেশ বাদ দিলে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬তম। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সূচকে বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২২তম এবং এশিয়ায় পঞ্চম।
ডা. শাহরিয়ার রোজেন জানান, রিপ্রোডাকশন রেট সংক্রামক ব্যাধির সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ লকডাউনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এই রিপ্রোডাকশন রেট বিবেচনা করে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেকদিন পর্যন্ত সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ের জন্য এই সূচকটি ব্যবহার করা হয়নি। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ রিপোর্টে এই সূচকটি ব্যবহার করা হয়েছে।
জুনের ২১-২৭ তারিখের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের ৬০টি জেলায় সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী (রিপ্রোডাকশন রেট ১.০০’র বেশি) এবং কেবল লালমনিরহাট, নওগাঁ, রাজশাহী ও সাতক্ষীরা জেলায় সংক্রমণের গতি নিম্নমুখী (রিপ্রোডাকশন রেট ১’র কম)।
কিছুদিন আগের কয়েকটি রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশের অধিকাংশ জেলার সংক্রমণের বর্তমান অবস্থা খুব ভয়াবহ (অধিকাংশ জেলা অতি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ)। পাশাপাশি, এই নতুন প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে, ভবিষ্যৎ আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উচ্চ রিপ্রোডাকশন রেট ইঙ্গিত করে যে, আগামীতে সংক্রমণ এবং মৃত্যু হার আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সংক্রমণের ভয়াবহতার কারণ মূলত দুটি
সিআরআইডিএ’র বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সংক্রমণের এই ভয়াবহতার কারণ মূলত দুটি। প্রথমত, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে মানুষের অনীহা এবং দ্বিতীয়ত অধিক সংক্রমণক্ষম ডেল্টা ভেরিয়েন্টের প্রভাব।
বিশ্লেষণে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ডেল্টা ভেরিয়েন্ট নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের সকল সংক্রমণই (৯৯ শতাংশ) হচ্ছে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট দিয়ে। ১ জুলাই যুক্তরাজ্যে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের প্রভাবে ২৭ হাজার ৬৪৬ জন আক্রান্ত হয়েছে; জানুয়ারির পর এটাই সর্বোচ্চ সংক্রমণ। ডেল্টা ভেরিয়েন্টের প্রভাবে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে রাশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে করণীয়
সিআরআইডিএ জানায়, কেবল সরকারি পদক্ষেপের মাধ্যমে এই ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, এক্ষেত্রে স্থানীয় নেতৃত্ব এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতে হলে জনসাধারণকে দুটি নিয়ম মেনে চলতে হবে।
প্রথমত, সঠিক নিয়মে মাস্ক পরতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
দ্বিতীয়ত, সকল ধরনের জনসমাগম পরিহার করতে হবে।
সার্জিকাল মাস্ক সকল ধরনের ভেরিয়েন্টের বিপক্ষে সুরক্ষা প্রদান করে। গ্রামাঞ্চলে সার্জিকাল মাস্ক পাওয়া না গেলে তিন স্তরের কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাদেশের শতকরা ৯৬ ভাগ জনগোষ্ঠী ভ্যাকসিনের আওতার বাইরে থাকায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।
সেন্টার ফর রিসার্চ, ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশনের বিশ্লেষণ ও লেখচিত্র প্রস্তুত করেছেন সেন্টার ফর রিসার্চ, ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশনের এপিডেমিওলজি বিভাগের ডা. কেএম তৌহিদুর রহমান, ডা. শাহরিয়ার রোজেন, ডা. আয়শা আকতার এবং ডা. নাজিফ মাহবুব।
এর আগে গত ২৬ জুন প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছিল, সারাদেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের অবিশ্বাস্য ঊর্ধ্বগতি হয়েছে। দেশে মোট ৬৪ জেলার ৫৯টিই অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ১৮ থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশের ৫৯টি জেলা অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে (সাপ্তাহিক শনাক্তের হার ১০ শতাংশের বেশি)। এর মধ্যে ৩৯টি জেলায় সংক্রমণের হার ভয়াবহ পর্যায়ের (সাপ্তাহিক শনাক্তের হার ২০ শতাংশের বেশি)।
প্রতিষ্ঠানটি জানায়, মাত্র ৭ দিনের ব্যবধানে মৃত্যুহার বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। জুনের ১৮ তারিখে দৈনিক মৃত্যু ছিল ৫৪, যা ৭ দিনের ব্যবধানে বেড়ে ১০৮ হয়েছে।
করোনায় মৃত্যুর সব রেকর্ড ভাঙল, শনাক্ত সর্বোচ্চ
দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে সংক্রমণ ধরা পড়েছে ৯ হাজার ৯৬৪ জনের শরীরে। এক দিনের হিসাবে শনাক্ত ও মৃত্যুতে এটি রেকর্ড।
সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়, দেশে এ পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছে ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮১ জনের দেহে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৫ হাজার ২২৯ জনের।
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের ৬০৫টি ল্যাবে করোনার ৩৪ হাজার ২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্ত হার ২৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। সার্বিক শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।
গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন আরও ৫ হাজার ১৮৫ জন। এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ৮ লাখ ৩৯ হাজার ৮২ জন। সুস্থতার হার ৮৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
গত এক দিনে মৃতদের মধ্যে পুরুষ ১০৯ জন, নারী ৫৫ জন। তাদের মধ্যে বিশোর্ধ্ব ৪, ত্রিশোর্ধ্ব ১২, চল্লিশোর্ধ্ব ১৮, পঞ্চাশোর্ধ্ব ৪৭ ও ষাটোর্ধ্ব ৮৩ জন।
বিভাগ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে খুলনা বিভাগে। এরপরই রয়েছে ঢাকা বিভাগ, ৪০ জন। এ ছাড়া রাজশাহীতে ১৬, চট্টগ্রামে ১৮, বরিশালে ৯, সিলেটে ৮, রংপুর বিভাগে ১৬ ও ময়মনসিংহ বিভাগে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে গত বছরের ৮ মার্চ। ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর সংবাদ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর আগে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের তথ্য প্রকাশ করা হয়। ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনে ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবের কথা ঘোষণা করে।
পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত বছরের ৪ জানুয়ারি থেকেই দেশের বিমানবন্দরসহ সব স্থল ও নৌবন্দরে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্ক্রিনিং শুরু করে। ওই বছরের ৪ মার্চ সমন্বিত করোনা কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৪
আপনার মতামত জানানঃ