১৯৫৩ সালে জিনজিয়াংকে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ ছিল হান আর ৭৫ শতাংশ ছিল উইঘুর মুসলিম। আজ এই উইঘুরেরাই দেশটিতে ‘ধর্মীয় চরমপন্থী’। এমনকি পাকিস্তানেও তারা উপেক্ষিত, নির্যাতিত। অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রতিপত্তিই এর পেছনের কারণ। পাকিস্তান এখানে অনেকটাই রুটির সামনে লেজ নেড়ে ডান বাম হেলতে থাকা পোষ্য। তবে হাতবদল হচ্ছে রুটিটা। এটা কখনও যুক্তরাষ্ট্রের হতে, কখনও চীনের। এখন চীনের।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের অভিযোগমতে, চীন প্রায় ১০ লাখ উইঘুরকে রি-এডুকেশন সেন্টার নামের বন্দিশালায় আটকে রেখেছে। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস ও আচরণ বদলে দিয়ে চীনাকরণ চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যেমন আফগান নারীদের মুক্তির জন্য যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল, চীন বলছে, তারা উইঘুর নারীদের কেবল সন্তান জন্ম দেওয়ার হাত থেকে মুক্তি দিচ্ছে। মুক্তি দিচ্ছে বন্ধ্যকরণ করে। বন্দিশালায় ধর্ষণের অভিযোগও করেছে পালিয়ে আসতে পারা উইঘুরেরা। আর এই নিপীড়ন নির্যাতনকে বৈধতা দিচ্ছে পাকিস্তান।
মুসলিম ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ের দাবিকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা দেয়ার কৃতিত্ব যতটা যুক্তরাষ্ট্রের অতটাই চীনের। আর এই কৃতিত্বের নতুন অংশীদার পাকিস্তান।
মুসলমানদের সব বঞ্চনা আর অত্যাচারের শেষ হিসেবে পরিচিত পাকিস্তান থেকেও আজ পালাতে হচ্ছে উইঘুরের মুসলমানদের। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশটিতেও চীনের নির্দেশে তাদের আটক করা হচ্ছে, বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে উইঘুরদের প্রতিষ্ঠান। চীনে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হলেও, অনেককে আবার সেই চীনেই ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ফেরত পাঠানো এই ব্যক্তিদের আর খোঁজও মিলছে না।
পাকিস্তান যেন জলের আকার। যে পাত্রে রাখা হবে, সেই পাত্রের রূপ। একসময় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ছিল তাদের গলায় গলায় খাতির। এখন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ভোল পাল্টে চীনের আশপাশে ঘুরঘুর করছে পাকিস্তান। টাকায় কাঠের পুতুল কথআ বলে। পাকিস্তানকে আগে টাকা দিত যুক্তরাষ্ট্র। এখন বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি) নামের মেগা প্রকল্পে ৬৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে চীন।
আর তাই তাদের অঘোষিত দাসত্ব প্রমাণে উইঘুরদের বিরুদ্ধে, চীনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও শামিল পাকিস্তানি সেনাসমর্থিত ইমরান খানের সরকার।
পাকিস্তানের গিলগিট-বাল্টিস্তান এলাকা চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের লাগোয়া। এখানেই উইঘুর মুসলমানদের বসবাস। তাদের নির্যাতনের ডার্করুম। যেহেতু এই গিলগিট-বাল্টিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির রোডম্যাপ ঠিক করে দিতে সক্ষম, তাই চীনের বিশেষ পরিকল্পনা আছে এই অঞ্চল নিয়ে। তাতে বাগড়া দিচ্ছে বালুচ স্বাধীনতাকামীরা। চীন চাইছে গিলগিট এলাকায় উইঘুরদের বিতাড়ন করতে হবে, চীনের হাতে তুলে দিতে হবে। এদিকে বালুচ স্বাধীনতাকামীরা আশ্রয় দিচ্ছে উইঘুরদের। এছাড়াও বালুচ বিদ্রোহীরা উইঘুরদের পূর্ব তুর্কমেনিস্তান স্বাধীনতা আন্দোলনে মদদ দিচ্ছে। চীনা রাষ্ট্রদূত অল্পের জন্য বোমা হামলা থেকে বেঁচে গেছেন। চীনা প্রকল্পে বালুচ বিদ্রোহীদের হামলার বড় বড় ঘটনাও আছে। তবে তাদের প্রতিরোধে পানি ঢেলে দিচ্ছে পাকিস্তান।
জিনজিয়াং এলাকা, যা একসময় উইঘুর সংখ্যাগরিষ্ঠ, তা চীনের দুটি কথিত স্বায়ত্তশাসিত এলাকার একটি। অন্যটি তিব্বত। এখানে চীনের ভূরাজনীতির ডার্ক সাইড স্পষ্ট হয়ে ওঠে বৃদ্ধের চামড়ায় বয়সের বলিরেখার মতো। তিব্বতের স্বাধিকার আন্দোলনকে সন্ত্রাসী আখ্যা না দিলেও নিরুপায় উইঘুরদের সন্ত্রাসী হুমকি হিসাবে দেখানো হচ্ছে। আর এজন্যই চীন ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম) নামক এক হুমকির সৃষ্টি করেছে, যা বিশ্ব জুড়ে ইসলামফোবিয়া তৈরিতে মদদ দিয়ে এসেছে। পাকিস্তানের গণমাধ্যমেও এই ইটিআইএমকে হুমকি মনে করা হয়, যা অনেকটা খাল কেটে কুমির আনা মুসলমানদের জন্য।
এমনকি ইসলামাবাদের চীনা কূটনৈতিক মিশনের উপপ্রধান লিজিয়ান ঝাও মনে করেন, পাকিস্তানি উইঘুরেরা ইটিআইএমের অংশ। চীন উইঘুরেদের ২০০৫ সালের উরুমকিতে বোমা হামলায় ১৪০ জনের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে। ঝাও সম্প্রতি চীনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টের পরিচালক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। তিনি মনে করেন, উইঘুরেরা জিনজিয়াংকে চীন থেকে আলাদা করতে চায়।
তাই ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’-এর নামে চীন চালিয়ে যাচ্ছে মুসলিম নিধন। মুসলিম ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ের দাবিকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা দেয়ার কৃতিত্ব যতটা যুক্তরাষ্ট্রের অতটাই চীনের। আর এই কৃতিত্বের নতুন অংশীদার পাকিস্তান। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সুবাদে আজ চীনের সরকারি দলিলে উইঘুরেরা মুসলিম ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ থেকে পরিণত হয় মুসলিম ‘ধর্মীয় চরমপন্থী’তে। সঙ্গে সঙ্গে তারা পাকিস্তানেরও সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর একটিতে পরিণত হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ