জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পানিসম্পদের অপচয় ও শিল্পখাতে পানির ব্যবহার বাড়তে থাকায় দিন দিন বেড়েই চলেছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। একইসাথে সংকটে স্যানিটেশন খাতও। পানি ও স্যানিটেশন খাতের উন্নতিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ইউনিসেফের তৈরি ‘জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম—জেএমপি প্রতিবেদন ২০২১’-এ এ চিত্র উঠে এসেছে। পানি ও স্যানিটেশন-সংক্রান্ত বৈশ্বিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি হয়।
সেখানে বলা হয়, গত পাঁচ বছরে এ দুই খাতে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছে ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের মতো দেশগুলো। অথচ এ দুই ক্ষেত্রে আগে বাংলাদেশের অগ্রগতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এসব খাতে এখন শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ মৌলিক স্যানিটেশনের সুবিধা পেত ২০১৫ সালে। ৫ বছর পর এসে তা দাঁড়িয়েছে ৫৪ শতাংশে। গত ৫ বছরে এ খাতে পাকিস্তান, নেপাল ও ভারত— এই তিন দেশের অগ্রগতি বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।
৫ বছর আগে পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ মানুষ এ সেবার মধ্যে ছিল। ৫ বছর পর তা দাঁড়ায় ৬৮ শতাংশে।
নেপালে ১৮ শতাংশ বেড়ে মৌলিক স্যানিটেশনের কভারেজ দাঁড়িয়েছে ৭৭ ভাগে।
ভারতে মৌলিক স্যানিটেশন ৫ বছর আগের চেয়ে ১৪ ভাগ বেড়ে ৭১ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তান। দেশটির জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ মৌলিক স্যানিটেশন-সুবিধা পাচ্ছে।
জেএমপি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের ২২ শতাংশ মানুষ এখনো অনুন্নত শৌচাগার ব্যবহার করে। স্বাস্থ্যের উন্নয়নে একে একটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে এ হার যথাক্রমে ২, ৩ ও ১৪ শতাংশ।
বাংলাদেশের ২২ শতাংশ মানুষ এখনো অনুন্নত শৌচাগার ব্যবহার করে। স্বাস্থ্যের উন্নয়নে একে একটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে এ হার যথাক্রমে ২, ৩ ও ১৪ শতাংশ।
নিরাপদ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত স্যানিটেশনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ গত ৫ বছরে উল্লেখ করার মতো তেমন উন্নতি করেনি। বাংলাদেশে নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবহারের হার ৩৯ শতাংশ। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো এগিয়েছে জোর কদমে। ভারত ৫ বছরে ৩৬ থেকে ৪৬ শতাংশে পৌঁছেছে। নেপালের প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবহারের সুযোগ পায়।
কিন্তু মলের জীবাণু, আর্সেনিক ও অন্যান্য দূষণমুক্ত নিরাপদ সুপেয় পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও পাইপের মাধ্যমে সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে। পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ হওয়া পানিকে বেশি নিরাপদ এবং শহরের নাগরিক সুবিধার অংশ বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ পাইপের পানি পায়, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন।
এ ক্ষেত্রে নেপালের অগ্রগতি বাংলাদেশের চেয়ে তিন গুণ, ৫০ শতাংশ। ভারতে এ হার ৪৪ আর পাকিস্তানের ২৬ শতাংশ। ২২ শতাংশ নিয়ে আফগানিস্তানের বর্তমান হারও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশের গ্রামের মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ সরবরাহের পানি পায়। শহরে এ হার ৩৬ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নেপালের গ্রামাঞ্চলে সরবরাহের পানি প্রাপ্তির হার সবচেয়ে বেশি। দেশটির ৪৯ শতাংশ মানুষ সরবরাহের আওতায় আছে। ভারতের গ্রামে এ হার ৩২ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৫ শতাংশ।
সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থার মতো স্বাস্থ্যবিধি বা হাইজিন করোনা প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে পাকিস্তান। দেশটির ৮০ শতাংশ মানুষ এ সুবিধা পায়। ভারত ও নেপালে এ হার ৬৮ ও ৬২ শতাংশ। বাংলাদেশের গ্রামে স্বাস্থ্যবিধি সুবিধা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। গ্রামাঞ্চলের মাত্র ৩৫ শতাংশ মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্যবিধির সুবিধা পায়। ভারত ও নেপালে এ হার ৬০ ও ৫৯ শতাংশ। পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি, ৭৪ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য খাতে বেশ উন্নতি হয়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে, পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে; নবজাতক ও প্রসূতিদের মৃত্যুর হার কমেছে। এই সব ক্ষেত্রেই অগ্রগতি হচ্ছে। তা সত্ত্বেও বলা যাবে না যে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে এই খাতের অগ্রগতি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তারা বলেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুফল সমাজের সব অংশের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। নিম্ন আয়ের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য, পুষ্টি ও সার্বিক স্বাস্থ্যগত অবস্থার উন্নয়নে এখনো অনেক কিছু করণীয় আছে। যেমন বিশুদ্ধ বা নিরাপদ খাওয়ার পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, কার্যকর পয়োনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাসস্থান-গৃহস্থালি ও কর্মস্থলের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা এবং ব্যক্তি, পরিবার ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামর্থ্য ও দক্ষতা বাড়ানো এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করা।
তারা বলেন, নিরাপদ খাওয়ার পানির ঘাটতি একটি বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশেও এই সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে। রাজধানী ঢাকায় ওয়াসার সরবরাহ করা পানি অনেক এলাকার মানুষ নিয়মিত পায় না। দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে লবণাক্ততা বাড়ার ফলে নিরাপদ পানির সংকট প্রকটতর হচ্ছে। লবণাক্ত খাওয়ার পানি ওই এলাকায় প্রসূতি মৃত্যুর উচ্চ হারের বিশেষ কারণ হিসেবে এক গবেষণায় জানা গেছে।
অনেক এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেশি থাকা বিরাট স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হচ্ছে। আর স্যানিটেশন ও হাইজিনের মান সারা দেশেই এখনো নিম্নপর্যায়ে রয়ে গেছে। গ্রামাঞ্চলের মনুষ্য বর্জ্য নিষ্কাশনে কিছুটা উন্নতি হয়েছে বটে, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি বা হাইজিন সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাব এখনো ব্যাপক। গৃহস্থালির স্যানিটেশন ও হাইজিনের বিশেষ উন্নতি ঘটেনি।
তারা বলেন, শুধু অর্থ বরাদ্দ বাড়ালেই চলবে না, সে অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের স্বাস্থ্য–সম্পর্কিত বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রায় শামিল হতে হলে আমাদের অবশ্যই এসব দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। তার আগে নিজেদের জন্য একটি জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে।
বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীতে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, তবে তার কারণ হবে ‘পানি’। তাই বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ ও যোগান নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা সাজানো উচিত। বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের দেশ বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৬
আপনার মতামত জানানঃ