ফিলিস্তিনি শিশুদের ধারণা ‘বিশ্ব তাদের পরিত্যাগ করেছে’। ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়েছে তাদের বসতবাড়ি, স্কুল, খেলার মাঠ। এবার কেড়ে নিচ্ছে কৃষি জমিও। তাদের নিরাপত্তা নেই, নেই ভবিষ্যৎ। তথাপি চুপ করে আছে গোটা বিশ্ব। গত ১০ বছরে ইসরাইল ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছে এমন ২১৭ ফিলিস্তিনি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ শিশুর অভিমত, বাবা-মা তাদের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম নয়। তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন।
জরিপে দেখা যায়, অধিকাংশ শিশুই চরম দুর্দশার মধ্যে নিমজ্জিত। তাদের মধ্যে হতাশা, ভয়, বিষণ্নতা ও উদ্বেগ কাজ করে। সেভ দ্য চিলড্রেনের মতে, ইসরায়েল কর্তৃক বাড়ি ধ্বংসের কারণে গত ১২ বছরে প্রায় ছয় হাজার শিশু বাস্তুচ্যুস্ত হয়েছে। সংস্থাটি জানায়, পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জারাহ ও সিলওয়ানে বসবাসরত ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির শঙ্কায় রয়েছে। এছাড়া ৩১ টি স্কুল ধ্বংস করা হয়েছে। দেশটিতে ২৪ হাজার শিক্ষার্থীর পড়াশোনা এখন বন্ধ। এর উপর সম্প্রতি রাস্তা নির্মাণের জন্য কেড়ে নেয়া হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের কৃষিজমি।
বাড়ি ধ্বংসের ঘটনা বাড়ছে
পশ্চিমতীরে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ধ্বংস বাড়িয়ে দিয়েছে বলে চলতি বছরের মার্চে জাতিসংঘের একটি সংস্থা সতর্ক করেছিল। ফিলিস্তিনের অঞ্চলগুলোতে মানবিক বিষয়গুলোর সমন্বয়ের জন্য জাতিসংঘের অফিস (ওসিএইচএ) থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ধ্বংসের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
ইসরাইলি কমিটি এগেইন্টস হাউস ডেমোলিশনসের তথ্যমতে, ১৯৬৭ সাল থেকে পশ্চিমতীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে প্রায় ২৮ হাজার ফিলিস্তিনির ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে।
দখলকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলোতে সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক জেসন লি বলেন, সেভ দ্য চিলড্রেন বিশ্বাস করে, ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ধ্বংসের কারণে গত ১২ বছরে কমপক্ষে ছয় হাজার শিশু বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা বিশ্বের জন্য ‘বেদনাদায়ক’ ও ‘সতর্কবার্তা’।
এক বিবৃতিতে লি বলেন, ফিলিস্তিনের ঘরবাড়ি ধ্বংস আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ। একই সঙ্গে এমন কর্মকাণ্ড শিশুদের নিরাপদ বাড়িতে বসবাসের অধিকারের লঙ্ঘন এবং নিরাপদে স্কুলে যাওয়ার পথে অন্যতম বাধা। অধিকৃত অঞ্চলের বাসিন্দাদের বিশেষ করে শিশুদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব ইসরাইলের।
তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরাইলকে এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো থেকে বিরত রাখতে সক্ষম না হয়, তবে ফিলিস্তিনি শিশুদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে।
ঘাসান নামে ১৫ বছর বয়সি এক শিশু সেভ দ্য চিলড্রেনকে বলে, আমার বাবাকে বাড়ি ধ্বংস করে দেয়ার সময় ইসরায়েলি সেনারা এবং তাদের কুকুরগুলো আক্রমণ করেছে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। এটা আমি এখনও ভুলতে পারছি না।
শিশুটি আরও জানান্য, এখনও আমি দুঃস্বপ্ন দেখি— বুলডোজার দিয়ে আমাদের বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। এ বাড়ি ভাঙার শব্দ আমাকে এখনও কষ্ট দেয়।
পশ্চিমতীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে যেসব ফিলিস্তিনির ঘরবাড়ি ইসরায়েলের বর্বর সেনাবাহিনী গুঁড়িয়ে দিয়েছে, সেসব পরিবারের পাঁচজনের মধ্যে চারজন শিশুই মনে করে বিশ্ব তাদের ‘পরিত্যাগ’ করেছে। সম্প্রতি পরিচালিত এক জরিপের ওপর ভিত্তি করে এমন তথ্য জানায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম মিডল ইস্ট আই।
৩১ টি স্কুল ধ্বংসস্তূপ
ইসরায়েলে বোমা হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা এলাকার কমপক্ষে ৩১টি স্কুল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেন এসব তথ্য জানিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, এ সহিংসতার ফলে গাজায় সব ধরনের শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। গাজার ২৪ হাজার শিক্ষার্থীর পড়াশোনা এখন বন্ধ।
ইসরায়েলের আক্রমণে সেভ দ্যা চিলড্রেনের গাজার কমিউনিকেশন অফিসার মাজেন নাঈম, তাঁর স্ত্রী ও তিন বছরের শিশু শোবার ঘরে আটকা পড়ে থাকার ঘটনা ঘটে।
গাজায় সেভ দ্য চিলড্রেনের ফিল্ড ম্যানেজার ইব্রাহিম আবু সোবেইহ বলেন, ‘আমরা আমাদের ছোট ছেলেমেয়েদের বলছি যে ভারী বোমাগুলো হলো উৎসব আর আতশবাজি, কেমন কৌতুক! এই ভয়াবহ পরিবেশ থেকে তাদের দৃষ্টি সরাতে আমরা বিভিন্ন উপায়ে অবলম্বন করছি, তবে এ সবই বৃথা।’
কেড়ে নেয়া হচ্ছে কৃষিজমি
পশ্চিমতীরের অবৈধ ইহুদি বসতির সাথে সহজ ও দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করতে ফিলিস্তিনের জমি দখল করে জেরুজালেম পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল। এতে বহু ফিলিস্তিনি কৃষক তাদের জমি হারানোর আতঙ্কে আছেন। এছাড়া কাটা পড়ছে অসংখ্য গাছ। আশঙ্কা করা হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়েরও।
নির্মাণাধীন আট কিলোমিটার এ রাস্তাটি পশ্চিমতীরের অবৈধ ইহুদি বসতি বেতার ইলিত থেকে জেরুজালেমের এতজিওন ব্লকে অবস্থিত আরেক ইহুদি পর্যন্ত যাবে।
চার মাস আগে এ রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইট ওয়াচ ইসরাইলের এ পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে।
হিউম্যান রাইট ওয়াচ বলছে, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে ফিলিস্তিনি কৃষকরা তাদের চাষাবাদের জমি হারাবেন। এটা আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী এবং মানবাধিকার পরিপন্থি কাজ বলে ইসরায়েলকে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাটি।
রাস্তাটি নির্মাণ করলে ফিলিস্তিনের কৃষকরা তাদের ফসলি জমি হারাবেন। এলাকাটি ফিলিস্তিনের কৃষি খামার হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে প্রকল্পটি ইসরায়েলের জনপ্রশাসন বিভাগের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। দখলদার দেশটির কট্টর ইহুদিবাদী সরকারের কর্মকর্তারা এটি অনুমোদনের ইঙ্গিতও দিয়েছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ