ব্রুনেইয়ে পরিশ্রম করে শ্রমিক থেকে ধীরে ধীরে নিজে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন বাংলাদেশের মেহেদী হাসান বিজন। বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়ে সেই প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করেন। পরিশ্রমে উপার্জিত রেমিট্যান্স তাঁরা মাসে মাসে পাঠাতেন দেশে। মেহেদী হাসানের স্বপ্ন ছিল দেশেও ওই প্রতিষ্ঠানের শাখা খুলে বিনিয়োগ করে দেশের উন্নয়নে অংশীদার হওয়া। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছেন ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের লেবার উইংয়ের কাউন্সিলর জিলাল হোসেন। হাইকমিশনের এই কর্মকর্তার ঘুষ-দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় প্রবাসী মেহেদী হাসানকে বানানো হয়েছে ভয়ংকর মানবপাচারকারী। মিথ্যা অভিযোগে আইনবহির্ভূতভাবে পাসপোর্ট বাতিল করে ব্রুনেই থেকে দেশে ফেরত পাঠানোর কয়েক মাসের মধ্যে ডজনখানেক মানবপাচারের সাজানো মামলায় আসামি করা হয়েছে মেহেদী হাসানকে। প্রবাসী মেহেদী বর্তমানে এসব মামলার ফেরারি আসামি হয়ে চরম উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
জানা যায়, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ব্রুনেই যান মেহেদী হাসান। শুরুতে সেখানে চাচা মাসুদ রানার প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। পরে ব্রুনেইয়ের ভাষা শিখে স্থানীয় ব্যবসায়ীর সহযোগিতায় ছোটখাটো কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু করেন। এরপর শুরু করেন রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। ওই ব্যবসা করতে তাঁর প্রয়োজন হয় কিছু কর্মী। বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে কর্মী নিতে ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনে আবেদন করেন তিনি। ব্রুনেই সরকারের অনুমোদন নিয়ে ভিসা সত্যায়নের জন্য বাংলাদেশ হাইকমিশনে যাওয়ার পরই ঘটে বিপত্তি। প্রতিজন কর্মীর ভিসা সত্যায়নে ৫০০ ডলার দাবি করেন ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের লেবার কাউন্সিলর জিলাল হোসেন। হাইকমিশনের দোভাষী আবু নাঈমের মাধ্যমে এ দাবির প্রতিবাদ করেন মেহেদী হাসান। এতে ক্ষুব্ধ হন জিলাল হোসেন। মেহেদী হাসানকে হাইকমিশনে ডেকে বলে দেন কর্মীপ্রতি ৫০০ ডলার না দিলে ভিসা সত্যায়ন করা হবে না। আর বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে মানবপাচারকারী মামলা দিয়ে ব্রুনেই থেকে বের করে দেওয়া হবে।
খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানালে প্রবাসী ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলামকে ব্রুনেই হাইকমিশনের ভেতরে আটকে নির্যাতন চালায় জিলাল সিন্ডেকেটের লোকেরা। এ ঘটনার ছয় দিন পর ঘুষ না দেওয়ায় আরেক প্রবাসী কামরুল ইসলামকেও হাইকমিশনের ভেতরে একই কায়দায় নির্যাতন চালায় জিলাল সিন্ডিকেট। ওই নির্যাতনের ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। ওই ঘটনায় ব্রুনেইয়ে মামলার পর কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও কৌশলে রক্ষা পান জিলাল হোসেন। জিলাল হোসেনের নির্দেশে দোভাষী আবু নাঈমসহ সিন্ডিকেট সদস্যরা প্রবাসী কামরুল ইসলামকে নির্যাতনের বিষয়টি পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন এমন একটি ভিডিওচিত্র কালের কণ্ঠ’র কাছে সংরক্ষিত আছে।
অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়ার নাগরিক সারা বিনতে আকিল নামে এক ব্যবসায়ী বাংলাদেশের ভিসার জন্য আবেদন করেন ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনে। ২০১৯ সালে দুইবার পাসপোর্টে বাংলাদেশি ভিসার সিল দেওয়ার পরও ঘুষ না দেওয়ায় ভিসার সিল কেটে দেওয়া হয়। পাসপোর্টে ভিসার সিল কেটে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান ওই মালয়েশীয় নাগরিক। ভিসার সিল কেটে দেওয়ার অভিযোগটি ভিডিওচিত্র ধারণ করেন মেহেদী হাসান, আবদুল্লাহ আল মামুন অপুসহ কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি। এ ঘটনায় আরো ক্ষুব্ধ হন জিলাল হোসেন। এর কয়েক দিন পরই মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে মানবপাচার, শ্রমিক নির্যাতন, হাইকমিশনের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য, মানহানিকর ভিডিওচিত্র তৈরি করে রাষ্ট্রদ্রোহসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে পাসপোর্ট বাতিলের আবেদন করে চিঠি পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে।
২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হাইকমিশনের চিঠিতে মেহেদীর নামে ৫০টির বেশি শ্রমিক নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়। এর ২৫ দিন পর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো আরেক চিঠিতে বলা হয়, মেহেদী হাসানের নামে শতাধিক শ্রমিক নির্যাতনের অভিযোগ করেছে। অথচ ঘুষের প্রতিবাদ করার আগে মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। ঘুষ দাবির প্রতিবাদ করার পরই তাঁর বিরুদ্ধে শুরু হয় এসব ভয়ংকর অভিযোগ।
মেহেদী হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লেবার কাউন্সিলর জিলাল হোসেন ও তাঁর সিন্ডিকেট আমার পাসপোর্ট বাতিল করে সেখানে আমার ব্যবসা নিজেদের লোক দিয়ে দখল করে আমাকে জোর করে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। পরিশ্রমে তিলে তিলে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান ফেলে রেখে খালি হাতে আমাকে দেশে ফিরতে হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রতিকার চেয়ে আমি একাধিক আবেদন করেছি স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। পাসপোর্ট ফেরত পেতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে রিট পিটিশনও করেছি।’স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিকার চেয়ে আবেদন এবং উচ্চ আদালতে রিট করার পর আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন জিলাল হোসেন। বিধি ভঙ্গ করে মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে একের পর এক চিঠি দিতে থাকেন বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের কাছে। দূতাবাস কর্মকর্তা জিলাল হোসেনের নির্দেশে কিছু সাজানো ব্যক্তি অল্প দিনের মধ্যে ঢাকা, নরসিংদী, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় ১০টির বেশি মানবপাচারের মামলা করেন মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে।
মেহেদী হাসান কালের কণ্ঠকে আরো বলেন, ‘ভিসার সত্যায়ন বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কথা বলায় আমি জিলাল হোসেনের রোষানলে পড়েছি। পাসপোর্ট বাতিল করে দেশে পাঠিয়েও ক্ষান্ত হননি তিনি, আমার নামে একের পর এক সাজানো মিথ্যা মানপাচারের মামলা দেওয়া শুরু হলো। আমি এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি। যেসব মামলা হয়েছে ওই মামলার বাদীরা চেনেন না আসামি কে। আসামিও চেনেন না বাদী কে।’ঘুষ ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করে জিলালের রোষানলে পড়ে ব্রুনেই থেকে আরো বিতাড়িত হয়েছেন শাহেদ মজুমদার মুন্না, জসিম সরকার, সোহরাব খান, মনির হোসেন, আসিফ হোসেন, রাসেল আহমেদ, জাকির হোসেনসহ অন্তত ২০ জন প্রবাসী।
প্রবাসী আসিফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় পাসপোর্ট জব্দ করে আমাকে পরিবারসহ দেশে পাঠিয়ে দেয় লেবার উইংয়ের জিলাল হোসেন সিন্ডিকেট।’
ব্রুনেই হাইকমিশনের লেবার কাউন্সিলর জিলাল হোসেনের বিরুদ্ধে প্রবাসীদের হয়রানি, নির্যাতন, ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশনে। ওই অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধানে নামে দুদক। অনুসন্ধানের জন্য চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহাবুব খান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাঠানো হয় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর। ওই চিঠিতে ব্রুনেই হাইকমিশনে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে দুদক কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে।
এসব বিষয়ে ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সিলর জিলাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মেহেদী হাসানের কাছে ভিসা সত্যায়নের জন্য কোনো টাকা দাবি করা হয়নি।’
পাসপোর্ট জব্দ করার আগে বাংলাদেশে মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে কোন মামলা ছিল না, আর যাঁরা মামলা করেছেন তাঁরা মেহেদী হাসানের নামই জানেন না, এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জিলাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেখুন বাংলাদেশে মামলা না থাকলেও ব্রুনেইয়ে মামলা ছিল। আর বাংলাদেশে যারা মামলা করছে, তারা জানে কেন মামলা করা হচ্ছে কিংবা তাকে আসামি করা হচ্ছে। মেহেদী হাসান একজন মানবপাচারকারী। তার প্রতারণার শিকার না হলে কেউ মামলা করত না। প্রতারণার শিকার হয়েই মামলা দিচ্ছে। তবে এসব বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রী ইমরান আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঘুষ-দুর্নীতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে কোনো প্রবাসী হামলার শিকার হবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিষয়ে আমরা দেখব।’
আপনার মতামত জানানঃ