অরুন্ধতী রায়ের সাহিত্যের শুরু ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ দিয়ে। যার প্রতিক্রিয়া ছিলো অবিশ্বাস্য, কোনও লেখক তার প্রথম বই নিয়ে যতটা আশাবাদী হতে পারে, তার থেকেও অনেকটাই বেশি ছিলো মানুষের প্রতিক্রিয়া। ওই বছরের শেষের দিকে এটি টাইম দ্বারা ১৯৯৭ এর পাঁচটি সেরা বইয়ের মধ্যে একটি গণ্য হয়। বইটি একই সাথে বেস্ট সেলার হয় এবং ১৯৯৭ সালে বুকার জেতেন অরুন্ধতী রায়। কিন্তু গত দুই দশক ধরে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে হেঁটেছেন তিনি। ভারত নিয়ে একের পর এক প্রবন্ধ লিখেছেন। ভারতের পলিটিক্স নিয়ে সবথেকে স্পষ্টভাষী সমালোচক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন। তিনি কাশ্মীর ও উপজাতি এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভূমিকার সমালোচনা করেছেন। তিনি ভারতে হিন্দু ডানপন্থীদের উত্থানের বিপক্ষে কথা বলেছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করেছেন। বছর ধরে, হুমকি পেয়েছেন বিভিন্ন দলের, ধর্মের মানুষের দ্বারা। এমনকি রাষ্ট্রদ্রোহে অভিযুক্তও হয়েছেন। মুক্তমনাদের কাছেও তিনি বিতর্কিত। এখানে, slate.com এ জুন ০৬, ২০১৭ তে প্রকাশিত সাংবাদিক আইজ্যাক কটিনারের নেয়া অরুন্ধতী রায়ের সাক্ষাৎকারের একটি বিশেষ অংশ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করেছেন সরকার শুভ্র।
‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ নিয়ে কাজ করাটা ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’য়ের থেকে কতটা আলাদা ছিল?
যখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ লিখতে কতোদিন সময় লেগেছিল, আমি বলি ৩৭ বছর। কারণ আমার কাছে ‘উপন্যাস’ কোন প্রোডাক্ট নয়। আবার এর মানে এই নয়, কোনকিছু দ্রুত লেখা হয়ে গেলে, আমি সেটার বিপক্ষে। সেগুলো গ্রেট আর্টও হতে পারে। কিন্তু আমার জন্য, এই উপন্যাসটা ঠিক যেন পাললিক শিলা। এতে অনেকগুলো লেয়ার আছে। একটার পর একটা। তারপর আর একটা। এবং এটা লিখতে আমার দীর্ঘদিন সময় লেগেছিলো।
আমার জন্য, উপন্যাস পৃথিবীকে দেখার চোখ।
এমন হতে পারে, আপনি উপন্যাসটা পড়ার সময় উপরের লেয়ারেই আটকে আছে। এরপর আবার পড়ার সময় আপনি এর ভিতরে ঢুকতে পারবেন এবং তারপর আপনি উপন্যাসের চরিত্র হয়ে যেতে পারবেন। যতবার এটা পড়া হয়, আমি মনে করি, গল্পটা পাল্টে যায়। এটা যেনো একটা শহরের ম্যাপ অথবা এটা কোনও শহর বা কোনকিছুকে জানতে চাওয়া। আমি কখনওই তাড়াহুড়ো করি না। কারণ আমি উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সাথে দীর্ঘসময় কাটাই। তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলি। [হাসি]
যখন আপনি বললেন যে উপন্যাস কোন প্রোডাক্ট নয়, আপনি কি এখানে প্রোডাক্ট কনজিউমার ক্যাপিটালিস্ট ধারণা থেকে বললেন?
প্রোডাক্ট বলতে আমি এমনকিছু বুঝিয়েছি, যা প্রায়ই আমাদের আলোড়িত করে। এই উপন্যাসটা লেখার আগের ২০ বছর, আমি অনেক ভ্রমণ করেছি, যেসব জায়গায় অনেক কিছু ঘটেছে, যেহেতু ভারত বদলে গেছে, আর পৃথিবীও। এর কিছু অভিজ্ঞতা রাজনৈতিক প্রবন্ধ আকারে লেখা হয়েছে। কিন্তু এমন অনেক কিছুই আছে যা ‘ফিকশন’ ছাড়া লেখা সম্ভব না। জানেন কি এটা?
আমার মনে হয় কেউই নন-পলিটিক্যাল উপন্যাস লিখতে পারবে না। আমার কাছে এটা একটা মিথ। আমি মনে করি, প্রত্যেকটা রূপকথাও কোনও না কোনওভাবে পলিটিক্যাল।
আমি কখনও একটি উপন্যাসকে পলিটিক্যাল বাস্তবতাকে হালকা করে প্রচারে ব্যবহার করবো না। আমার জন্য এই সমস্ত ঘটনা, আমার ভেতর গেঁথে গেছে, ভেঙে চুরমার হয়ে মিশে গেছে শরীরে এবং এরপর ঘটনাগুলো ঘাম হয়ে বেরিয়ে যায়। এর কারণ এই নয় যে, আমি বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলাপ করতে চাই। আমার জন্য, উপন্যাস পৃথিবীকে দেখার চোখ।
আপনি কি কখনও নন-পলিটিক্যাল উপন্যাস লিখতে পারবেন বলে মনে করেন?
আমার মনে হয় না, কেউই নন-পলিটিক্যাল উপন্যাস লিখতে পারবে। আমার কাছে এটা একটা মিথ। আমি মনে করি, প্রত্যেকটা রূপকথাও কোনও না কোনওভাবে পলিটিক্যাল। যখন আপনি কোনও কিছু এড়িয়ে যাবেন, তখন ওটা অতোটাই পলিটিক্যাল, যতোটা আপনি যখন সেই বিষয়টাকে পলিটিক্যাল বলে মেনে নেবেন।
‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ কি আপনাকে ভারতের অবস্থানকে গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে, সেটা কাশ্মীর হতে পারে বা দিল্লি বা যেকোনও কিছু?
হ্যাঁ, অবশ্যই। আমার কাছে কীভাবে গল্পটা বলা হচ্ছে, সেটা যতোটা গুরুত্বপূর্ণ, অতোটাই গুরুত্বপূর্ণ গল্পটা। যখন আপনি কাশ্মীরের মতো জায়গা নিয়ে লিখছেন অথবা মধ্য ভারতের জঙ্গলে কী হচ্ছে তা নিয়ে লিখছেন, সেটা যাই হোক, আমি বলবো, ফিকশন সত্যকে উপস্থাপন করে। কারণ মাঝেমাঝে এই সব জায়গায় কী হচ্ছে, সেই আতঙ্ককে শুধুমাত্র তথ্য এবং প্রমাণাদি নির্ভর সংবাদ দিয়ে উপস্থাপন করা যায় না। একমাত্র ‘ফিকশন’ পারে সত্য ঘটনাকে তুলে ধরতে। ফিকশনই সেই হাওয়াটাকে ধরতে পারে, যা মানুষকে পলিটিক্যাল দাস বানাচ্ছে। ফিকশন সেই গল্পটা বলতে পারে, কীভাবে মানুষ ভয়ের সাথে বাস করছে, বছর পর বছর ধরে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে ত্রাসের রাজত্বে।
হাজার হাজার পলিটিক্যাল কর্মী আছে, যারা ভারতকে ওই জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে তারা একে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ বলে ঘোষণা করতে পারবে।
ভারতের পলিটিক্স নিয়ে বললে, আমরা পপুলিস্ট নেতাদের উত্থান দেখতে পাই এবং সারা পৃথিবী জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘ফেইক নিউজ’। ভারত থেকে তুরস্ক, তুরস্ক থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুরোপ। গোটা পৃথিবীর আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠার আগে, ভারতে এই প্রবণতাটা আপনি কতোটা লক্ষ্য করেছেন?
সম্প্রতি, আমি দিল্লিতে কিছু সাংবাদিকদের সাথে ছিলাম। ভারতে কী ঘটছে তার প্রকৃত অবস্থা তাদের সবাইকে আতঙ্কিত করে রেখেছিলো এবং তারা তা নিয়ে কথাও বলতে পারছিলো না। কারণ ভারতের আজকের প্রকৃত ছবি বলিউড, মুক্ত বাজার এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির ঠিক নাকের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে কী ঘটেছিল আর কী ঘটছে, তার পার্থক্যটা একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, যা কিনা এখানে ভেবেচিন্তে সাজানো হচ্ছে। এখানে হাজার হাজার পলিটিক্যাল কর্মী আছে, যারা ভারতকে ওই জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে তারা একে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ বলে ঘোষণা করতে পারবে।
আজকের ভারত পলিটিক্সের কাছে বাজারবান্ধব, বলিউডমুখী, অবুঝ এবং ফুটফুটে একটা খেলনা।
আমি একথা সবাইকে বলি, যদি ভারত মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ না করতো, যদি ভারতের অর্থনীতি এতোটা শক্তিশালী না হতো, তাহলে আজ ভারত বলতে আমরা গণহত্যা, রাসায়নিক অস্ত্র, রাস্তায় নির্দোষ মানুষদের শাস্তি দেয়া এবং দলিতদের উপর হওয়া অন্যায় অত্যাচারের গল্প বলতাম। ঠিক এই মুহূর্তে পলিটিক্যাল ক্ষমতা দেখিয়ে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ধর্মান্ধ মানুষ এবং দল, মুসলমানদের দাড়ি ধরে টানছে, জোর করে হিন্দুত্ববাদী স্লোগান দেয়াচ্ছে, অত্যাচার করছে।
আপনি কীভাবে ধর্মীয় সহিংসতা এবং জাতীয়তাবাদ এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতিক একসাথে যুক্ত করছেন? কারণ ইতিপূর্বে আপনি মুক্ত বাজার অর্থনীতি নিয়ে খুব সাবলীল সমালোচনা করেছেন। তাই আপনি এখন যা বলছেন, তার জন্য কেন মুক্ত বাজারকে দায়ী করছেন?
না, না। মুক্ত বাজার এসের জন্য দায়ী নয়, কিন্তু মুক্ত বাজারকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া ক্ষমতার বলয় এর জন্য দায়ী। এটি আন্তর্জাতিক অর্থায়নের সুযোগ তৈরি করেছে, একইসাথে নিষ্ঠুরতা এবং ধর্মান্ধতাকে ঢেকে রাখারও। কোনও দেশে যদি কোনও সরকার প্রধান গণহত্যার উপর দিয়ে হেঁটে ক্ষমতায় আসে, যদি মুসলমানদের উদ্বাস্তু শিবিরে রাখা হয়, বাইরের দেশে তা অবশ্যই ভিন্ন চোখে দেখা হবে, কিন্তু ভারতে নয়। এখন, আজকের ভারত পলিটিক্সের কাছে বাজারবান্ধব, বলিউডমুখী, অবুঝ এবং ফুটফুটে একটা খেলনা।
আপনি কি মনে করেন, যে এই মুক্ত বাজারের কোন ইতিবাচক প্রভাব আছে ভারতে?
এমন কোনও কিছু নেই, যেখানে আপনি বলতে পারবেন, এর পুরোটাই খারাপ বা ভালো। এটা আপনি কখনওই বলতে পারবেন না, কিন্তু যখন দেখবেন, অবৈধ দখলদারিত্ব, পরিবেশগত বিপর্যয়, মানুষকে তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, শহরের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে তাদের, কিন্তু শহর তাদের ভার নিতে হিমসিম খাচ্ছে, তখন আমি বলবো, এর মধ্যে কিছু একটায় ভয়াবহভাবে সমস্যা আছে। তবে তার মানে এই না যে, সবকিছু ফেলে পুরনো অবস্থায় ফিরে যেতে হবে। বরং আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে, সমস্যাটা কোথায়। আমার একটা প্রবন্ধ, নাম ‘দ্য ডক্টর এন্ড দ্য সেইন্ট’। এটি গান্ধী এবং বি আর আম্বেদকরকে নিয়ে। প্রবন্ধতে আমি গান্ধীকে তার ‘আগে সবকিছুই দারুণ ছিল এবং এখন সবকিছুই ভয়াবিহ’ কথার জন্য সমালোচনা করেছি। আমি এটা বলছি না। কিন্তু আমি গ্রামে মহিলারা যে সমাজে, যে সংস্কৃতির মধ্যে বাস করে, সেখানে বড় হয়েছি, সেই সংস্কৃতির শেকড় ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছি।
এটা এমন দেখায়, বিশদে বললে, আন্তর্জাতিকভাবে জাতীয়তাবাদীদের এবং বিশ্বায়নবাদীদের মধ্যে একটা বিতর্ক আছে। ভারতে ডানপন্থীদের জনপ্রিয়তা আছে, আবার আন্তর্জাতিক গণ্যমান্যরা আছে যারা সর্বসাধারণ থেকে আলাদা। এ অবস্থায় এই বিতর্কটা কীভাবে ভারতে আছে?
ভারতে, এটা একটা ভুল বিতর্ক। কারণ যারা ভারতে মূলত র্যাডিক্যাল জাতীয়তাবাদী হিসেবে নিজেদের দাবি করে, তারাই এই নব্যউদারনীতিবাদী মুক্ত বাজারের সমর্থন করে। সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করে। তাই এই বিতর্কটা পুরোপুরি ভুল ভাবে ভারতে উত্থাপিত হচ্ছে। মূলত একটা গোষ্ঠী আমাদের এইভাবে বিতর্ক করাটা পছন্দ করে। কিন্তু আসল ঘটনা তা নয়, যা আমরা ভাবি।
আপনার মতামত জানানঃ