মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে বিজেপি নেতাদের মন্তব্য প্রসঙ্গে সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় লেখক, বুদ্ধিজীবী ও অ্যাকটিভিস্ট অরুন্ধতী বলেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদ ভারতের অস্তিত্বের প্রতি যে হুমকি তৈরি করেছে তাকে বাইরের দুনিয়া থেকে বেশ সফলভাবে আড়াল করে রাখা হয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তা উন্মোচিত করে দিয়েছে।
তোমরা এখানে ক্যাপিটল হিলে হামলাকারী সেই পশম আর শিংওয়ালা মানুষটিসহ অদ্ভুত পোশাকের লোকগুলোকে দেখেছ। আমরা ভারতে তাদেরই জাতভাইদের দ্বারা শাসিত হচ্ছি। পার্থক্য শুধু এটুকু যে, ভারতের ওরা তোমাদের এদের মতো এতটা আবোলতাবোল বকা উন্মাদ নয়। তারা ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের সদস্য, যার প্রতিষ্ঠাতারা প্রকাশ্যেই হিটলারের প্রশংসা করতেন এবং ভারতের মুসলমানদের জার্মানির ইহুদিদের সঙ্গে তুলনা করতেন।
এরপরও মোদি ও তার অনুসৃত রাজনীতির জনপ্রিয়তা না কমার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ফেসবুক ও টুইটারের অ্যালগরিদম নিয়ে বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভদ্রতার চেয়ে ঘৃণা অনেক অনেক বেশি লোক টানতে পারে। মোদির জনপ্রিয়তা বজায় থাকার কারণটাও এখানে।
দুর্দশাগ্রস্ত, নিপীড়িত, বেকার ও চরম দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ আরও নারকীয় পরিস্থিতিতে পতিত হওয়ার জন্য ভোট দেয়; কারণ তাদের চোখ নিবদ্ধ তারা যাকে ঘৃণা করে তার ওপর। করোনা মোকাবিলা করতে গিয়ে মোদি চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন; প্রথমবার হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করে লাখ লাখ কর্মহীন মানুষকে একেবারে হেঁটে হাজার হাজার মাইল দূরের বাড়িতে যেতে বাধ্য করেছিলেন। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় লাখ লাখ লোক অসহায়ভাবে মরেছে।
তারপরও কিছু মানুষ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘মোদি না থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো!’ মোদি যত বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন এর একদিনও তিনি কোনো সংবাদ সম্মেলনে আসেননি। জবাবদিহি তাঁর অভিধানে নেই। তাঁর যেসব কর্মকাণ্ড আর ছবি আমাদের দেখানো হয় তার সবই মঞ্চের পেছন থেকে নিয়ন্ত্রিত।
মোদি প্রসঙ্গে অরুন্ধতী বলেন, আসলে আমাদের দুনিয়া ঘুরে বেড়ানো এবং সুযোগ পেলেই রাষ্ট্রপ্রধানদের বুকে জড়িয়ে ধরা প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বেশ সচেতন। তাকে কিন্তু এ পর্যন্ত কেউ একজন সাধারণ ভারতীয়কে বুকে জড়িয়ে ধরতে দেখেননি।
তার প্রতিটি বিদেশ ভ্রমণের কর্মসূচি খুব পরিকল্পিতভাবে ঠিক করা হয়। তার লাখ লাখ অনুসারী তাকে বলেন বিশ্বগুরু। আর বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্প, অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, ইমানুয়েল মাখোঁ ও বরিস জনসনরা এতে মদদ জোগান। আন্তর্জাতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বাস্তববাদের নামে সুবিধাবাদী একটা খেলা মাত্র। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই; এর পুরোটাই যুক্ত বাণিজ্য, ভূরাজনীতি, বর্ণ, ধর্ম ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের সঙ্গে।
মোদি খুব ভালো করে জানেন যে, ভারত ফ্রান্সের কাছ থেকে যুদ্ধবিমান কিনলে এখানে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা বা গণহত্যা হলেও ফ্রান্স বড়জোর একটু আঙুল তুলে তাকে সতর্ক করবে। আপনি নৈতিকতার যতই ধস নামান আপনার যদি একটা বিশাল বাজার থাকে তা আপনাকে ইন্স্যুরেন্সের মতোই সুরক্ষা দেবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বর্তমানে ভারতকে একটু চালাকির আশ্রয় নিতে হচ্ছে; রাশিয়ার সঙ্গে তার নৈকট্যের কারণে তাকে এখন কাশ্মীরে সংঘটিত অপরাধ এবং সহিংস হিন্দু জাতীয়তাবাদের জন্য পশ্চিমাদের কাছে একটু জবাবদিহি করতে হচ্ছে। কিন্তু এগুলো ওই বিশাল খেলায় দরকষাকষির হাতিয়ার বৈ কিছু নয়।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতকে নিয়ে অরুন্ধতীর মন্তভ, গণতন্ত্র মানে নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠান নয়। ২০ কোটি ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে অধিকারবঞ্চিত রেখে আপনি গণতান্ত্রিক হতে পারেন না। একদিকে আপনি তাকে গণপিটুনিতে খুন করবেন, বিনাবিচারে জেলে পুরে রাখবেন, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে একঘরে করে রাখবেন, কোনো বাধা বা জবাবদিহি ছাড়া তার ঘর ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেবেন, তার নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে বলে হুমকি দেবেন আর অন্যদিকে ওই খুনিদের রাজনৈতিক সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে সুযোগ করে দেবেন- একটা গণতান্ত্রিক দেশে তা হতে পারে না।
অরুন্ধতী বলেন, যেভাবে দশকের পর দশক ধরে হিন্দুত্ববাদীরা মানুষের মগজ ধোলাই করেছে তার সংশোধন সত্যিই কঠিন। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ভারসাম্য রক্ষাকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এখন অন্য উদ্দেশ্যে নিয়োজিত; এদের সবারই কাজ এখন হিন্দু জাতীয়তাবাদের সুরক্ষা দেওয়া। আঞ্চলিক পর্যায়ে যেমন পশ্চিমবঙ্গে, কেরালায়, তামিলনাড়ূতে, পাঞ্জাবে বিজেপিকে পরাস্ত করা যাচ্ছে, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে এমন কেউ নেই।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, হিন্দুত্ববাদে অন্ধ মানুষকে আপনি কী দিয়ে কাছে টানবেন? আপনি আরও বড় হিন্দুত্ববাদী? এখন তেমনটাই ঘটছে ভারতে। বিশেষ করে মূলধারার দলগুলো এ খেলায়ই রত আছে এখন। তবে হিন্দুত্বের এ খেলায় কারও পক্ষেই বিজেপিকে হারানো সম্ভব নয়।
কাজেই আমি মনে করি না, ওই ক্ষতি পূরণ করা যাবে। আমার মনে হয় আমরা ভেঙে পড়ব, তারপর আবার জন্ম নেব। পরিবর্তন কেবল তখনই আসতে পারে, যখন ভোলাভালা, নিয়তিবাদী এ মানুষ বুঝতে পারবে তাদের কোথায় নামানো হয়েছে। এ পরিবর্তনটা আসতে পারে আকস্মিক এবং অবশ্যই রাজপথ থেকে, বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে নয়। ততদিন ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন, এ কামনা করি।
বর্তমানে বহু কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী জেলে আছেন, যাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যারা আসলেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। পরিস্থিতিটা অনেকের মধ্যেই এমন একটা অনুভূতি তৈরি করছে যে, ফ্যাসিবাদের অধীনে একটা নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপনের কোনো অর্থ নেই। দুনিয়া যখন রসাতলে যাচ্ছে তখন বেস্ট সেলিং লেখক হওয়ার কী মূল্য আছে? আমি সেই অভাগা লোকদের একজন, যারা কয়েক দশক ধরে এ পরিস্থিতিটা তৈরি হতে দেখছি। আমি সেই ক্ষ্যাপা লোকদের একজন, যারা আগুনের সংকেত বাজিয়েছিল এমন এক সময় যখন পার্টি খুব জমে উঠেছে। এর জন্য আমাকে মূল্যও দিতে হয়েছে।
হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা আমাকে তাদের ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’ তালিকার প্রথম ধাপে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। কাশ্মীর নিয়ে লেখার কারণে বলিউড থেকে আসা বিজেপির এক সাংসদ আমাকে সেনা জিপের সামনে বেঁধে মানববর্ম হিসেবে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিল। তারা যে তা করতে পারে আমি এটা বিশ্বাস করি। দুঃখজনকভাবে, ম্যাক্রো লেভেলে বিজেপির এ চরমপন্থা এখন মাইক্রো লেভেলেও ছড়িয়ে পড়েছে। তার মিত্ররা তো বটেই, দলটির দ্বাররক্ষীরা, তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীরা এমনকি এ ভুক্তভোগীরাও এখন এ ঘৃণা রোগে আক্রান্ত।
যখন সবাই অন্তর্মুখী, তিক্ত ও মতবাদ প্রচারক হয়ে পড়ছে এবং টিভি পর্দায় গতানুগতিক মুখগুলো তাদের বায়বীয় আদর্শের বুলি নিয়ে একে অপরের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে তখন আমিও যেন গুটিয়ে যাচ্ছি। আমাকে প্রতিদিন এ অবস্থার বিরুদ্ধে লড়তে হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ