টানা তিন বছর সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমানো অর্থের পরিমাণ কমতে দেখা যাচ্ছে। আগের বছরের তুলনায় সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ ৭ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশের মানুষের কমলেও সুইস ব্যাংকে ভারতীয় ও পাকিস্তানিদের জমা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) গতকাল বৃহস্পতিবার ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০২০’ বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখান থেকে বাংলাদেশিদের অর্থ জমার এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে পাচার সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। এমনকি আমানত হিসাবে কার কত অর্থ আছে, তা-ও জানা যায়নি।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সাল শেষে দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ আগের বছরের ৬০ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ থেকে কমে ৫৬ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা (১ সুইস ফ্রাঁ =৯২.২৮ টাকা)। এই নিয়ে পরপর তিন বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ কমল।
তবে ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষের কমলেও সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের জমা অর্থের পরিমাণ ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠেছে। ২০২০ সাল শেষে ভারতীয়দের জমা অর্থের পরিমাণ ২৬০ কোটি সুইস ফ্রাঁ, যা ২০১৯ সালে ছিল ৮৯ কোটি ৯০ লাখ। পাকিস্তানের আমানতও বেড়েছে ৭৭ দশমিক ৮ শতাংশ, হয়েছে ৬৪ কোটি সুইস ফ্রাঁ।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ, ২০১৮ সাল শেষে এই অর্থের পরিমাণ কমে হয় ৬২ কোটি সুইস ফ্রাঁ। ২০১৯ সালে দাঁড়ায় ৬০ কোটি ৩০ লাখে। ২০২০ সাল শেষে হলো ৫৬ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ।
সুইজারল্যান্ডের ২৪৩টি ব্যাংকের যে হিসাব দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়েছে, তাতে একক দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের জমা অর্থের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, ৩৭৭ বিলিয়ন সুইস ফ্রাঙ্ক। এর পরের অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জমার পরিমাণ ১৫২ বিলিয়ন সুইস ফ্রাঙ্ক। তালিকায় এর পরে রয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ফ্রান্স, হংকং, জার্মানি, সিঙ্গাপুর ও লুক্সেমবার্গের নাম।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে বিনিয়োগ না হওয়ায় সুইস ব্যাংকে অনেকেই টাকা রাখছেন। বাংলাদেশের নিয়ম অনুযায়ী যেকোনও ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন অন্তত ৫০০ কোটি টাকা হতে হয়। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যে টাকা এখন জমা আছে, তা অন্তত ১০টি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সমান।
সারাবিশ্বে ধনী ব্যক্তিদের টাকা সুইস ব্যাংকে রাখার আগ্রহের পেছনে মূল কারণ দেশটির গোপনীয়তা নীতি। সুইজারল্যান্ডের আইনে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য নয়। টাকার উৎসও তারা জানতে চায় না। তবে কোন দেশের গ্রাহকদের কী পরিমাণ অর্থ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে জমা আছে, তার একটি ধারণা প্রতিবছর এসএনবির বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদের বাধ্যবাধকতা মেনে এসএনবি ওই তথ্য প্রকাশ করলেও সেখানে গ্রাহকের বিষয়ে কোনও ধারণা পাওয়া যায় না।
দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাষ্য হল, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যে টাকা জমা রয়েছে, তার বেশিরভাগটাই অবৈধভাবে অর্জিত এবং বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
বিদেশি ব্যাংক বিশেষ করে সুইস ব্যাংকে পাচার করা ‘বিপুল পরিমাণ’ অর্থ উদ্ধারের যথাযথ পদক্ষেপের নির্দেশনা চেয়ে কয়েক মাস আগে একটি রিট আবেদন হয়েছে হাই কোর্টে।
প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আদালত সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের কতজনের কত টাকা আছে সেই তালিকা চেয়েছে সরকারের কাছে। পাশাপাশি পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অর্থের পরিমাণ প্রথমবার দশ কোটি সুইস ফ্রাঙ্ক ছাড়িয়ে যায় ২০০৬ সালে, যেটি ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ বছর। নয় কোটি ৭২ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক থেকে বেড়ে ওই বছর জমার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ কোটি ৪৩ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক।
এরপর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম বছর ২০০৭ সালে জমা অর্থের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ২০ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক হয়।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১১ সালে জমার পরিমাণ ছিল ১৫ কোটি ২৩ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক, তা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৭ সালে তা ৬৬ কোটি ১৯ লাখে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, সুইস ব্যাংকগুলোতে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি অর্থ জমা রাখতে পারেন। তবে সরাসরি বাংলাদেশ থেকে টাকা নিয়ে সে দেশে জমা করার সুযোগ নেই। কঠোর গোপনীয়তার কারণে অর্থ গচ্ছিত রাখার নিরাপদ স্থান হিসেবে সুইজারল্যান্ড অর্থ পাচারকারীদেরও নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চাপের মুখে সুইস ব্যাংকগুলোর এই কঠোর গোপনীয়তার নীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক শিথিল করতে বাধ্য হয়েছে। সেখানে গচ্ছিত অর্থ যদি কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, সেক্ষেত্রে গ্রাহকের পরিচয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে তারা তথ্য দিতে বাধ্য। এ জন্য সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ গচ্ছিত রাখার প্রবণতা কমতে পারে।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ কমার বিষয়টি একেবারেই স্বাভাবিক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, নানা কারণে এটি কমতে পারে, বাড়তে পারে। এখানে তো বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকের টাকা থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের থাকে, অন্য ব্যাংকের থাকে। তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশের নাগরিকেরাও দেশটিতে অর্থ জমা রাখেন। হতে পারে জামানাত বিভিন্ন জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। যে সময় পর্যন্ত হিসাব দেওয়া হয়েছে, সে সময়ে হয়তো কিছু উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। আবার জমা হতে পারে।
তারা বলেন, সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখলে এখন খুব বেশি মুনাফা পাওয়া যায় না। সে কারণে হয়তো অনেকে সেখান থেকে অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। বেশি মুনাফার আশায় কেউ কেউ সেই টাকা বাংলাদেশেও ফিরিয়ে আনতে পারেন। আসলে সুইস ব্যাংককে যে ট্যাক্স হ্যাভেন বলা হতো, সেটা এখন আর নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ