মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী আন্দোলনকারীরা রোহিঙ্গাদের সমর্থন জানিয়ে বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেছেন। আন্দোলনের ডাকে চালু করা হ্যাশট্যাগ টুইটার ট্রেন্ডে শীর্ষে রয়েছে। খবর এএফপি
গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে রক্তপাতহীন সেনা অভ্যুত্থান হয়। গত বছরের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) অভাবনীয় বিজয় প্রত্যাখ্যান করে জান্তারা ক্ষমতা দখল করে নেয়। আটক করা হয় সু চিসহ এনএলডির কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে।
এর পর থেকে জান্তাবিরোধী তুমুল বিক্ষোভে দেশটিতে ৮৫০ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছেন। নিজ দেশের মানুষের ওপর দমনপীড়ন চালানোয় জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের ওপর দেশি-বিদেশি চাপ বেড়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে জান্তাদের হটাতে এনএলডির ক্ষমতাচ্যুত আইনপ্রণেতারা গঠন করেছেন জাতীয় ঐক্যের সরকার।
গত বৃহস্পতিবার ছায়া সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। ওই বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা রয়েছে।
বিবৃতিতে ছায়া সরকার বলেছে, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের জান্তাবিরোধী চলমান লড়াইয়ে অংশ নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।’ বিবৃতিতে রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর আগে সু চির এনএলডি সরকার এ শব্দের ব্যবহার এড়িয়ে যেত। রোহিঙ্গাদের ‘রাখাইনে বসবাসকারী মুসলিম’ বলে সম্বোধন করা হতো।
এই প্রতিশ্রুতি প্রকাশের পর মিয়ানমার জান্তার এক মুখপাত্র রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ঝাও মিন তুন বলেন, রোহিঙ্গা হলো একটি কাল্পনিক নাম। যারা নিজেদের এই নামে অভিহিত করে তারা আসলে ‘বাঙালি’।
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের স্বীকৃত জাতিগুলোর তালিকায় নাই। তালিকা ও আইন অনুসারেই মিয়ানমার নাগরিকত্ব দেবে।
জান্তা মুখপাত্রের এই মন্তব্যের পর রবিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন জানানো শুরু করেন দেশটির গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীরা। তারা ব্ল্যাক৪রোহিঙ্গা হ্যাশট্যাগে কালো পোশাক পরে প্রতিরোধের প্রতীক তিন আঙ্গুল দেখিয়ে ছবি প্রকাশ করছেন।
দেশটির প্রখ্যাত মানবাধিকারকর্মী থিনজার শুনলেই ইয়ি টুইটারে লিখেছেন, আপনাদের প্রত্যেকের এবং মিয়ানমারে আমাদের সবার ন্যায়বিচার নিশ্চিত হতে হবে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে একটি ছোট প্রতিবাদের কথাও জানা গেছে। মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনে এই বিক্ষোভ হয়। কালো চাদরে মোড়া বিক্ষোভকারীরা বার্মিজ ভাষায় স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাজির হন। তারা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করছেন।
রবিবার দুপুরে #Black4Rohingya হ্যাশটাগটি মিয়ানমারে টুইটার ট্রেন্ডিংয়ে চলে আসে। হ্যাশট্যাগটির উল্লেখ ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার বারের বেশি। এই সমর্থন জানানো মানুষের মধ্যে রয়েছে মূলত বৌদ্ধ, বামার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। এক বছর আগে এসব মানুষের অবস্থান ছিল বিপরীত মেরুতে। এমনকি ওই সময় রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহার করাই ছিল বিতর্ক উসকে দেওয়ার মতো।
মিয়ানমারের বিভিন্ন ব্যবসায়িক কেন্দ্রেও রবিবার বিক্ষোভ হয়েছে। সেখানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই রোহিঙ্গাদের সমর্থন জানান।
মিয়ানমারে সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রাখাইনের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়। রোহিঙ্গা মুসলিমদের মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও অতীতের বেসামরিক সরকার বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দাবি করে। কয়েক দশক ধরে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি জরুরি সেবা ও যাতায়াতের স্বাধীনতাও নেই।
২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় সাড়ে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে সাড়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয়ে রয়েছে। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ মিয়ানমার সরকারকে চাপ দিলেও এ নিয়ে গড়িমসি করে আসছে দেশটি।
আজ সু চির বিচার
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার হাতে ক্ষমতাচ্যুত অং সান সু চির বিচার শুরু হতে যাচ্ছে।
দেশটিতে চার মাসের বেশি সময় ধরে চলা সামরিক শাসনের অধীনে সোমবার সু চির বিচার শুরু হচ্ছে বলে দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চির বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ আনে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। ১১ কেজি সোনা বেআইনিভাবে নেয়া থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট লঙ্ঘনের অভিযোগ অন্যতম।
বেআইনিভাবে ওয়াকিটকি আমদানি ও গত বছরের নির্বাচনের সময় করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ লঙ্ঘনের অভিযোগে সোমবার শুরু হতে যাওয়া বিচারে সু চির আইনজীবী দল সাক্ষীদের জেরা করবে।
সু চির আইনজীবীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, আগামী ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে বিচার শেষ হবে বলে ধারণা তাদের। প্রতি সোমবার আদালতে সু চির বিরুদ্ধে করা অভিযোগের শুনানি হবে।
সু চির বিরুদ্ধে সামরিক সরকারের সব অভিযোগ আদালতে প্রমাণ হলে এক দশকের বেশি সময় কারাদণ্ড হতে পারে ৭৫ বছর বয়সী নেতার।
অভিযোগের বিষয়ে কেবল দুইবার সু চির সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পান তার আইনজীবীরা।
মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে শুনানি শুরুর আগে সু চির আইনজীবী খিন মং জো বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘আমরা ভালো কিছু আশা করছি। তবে আমাদের প্রস্তুতি ভালো নয়।’
মঙ্গলবার সু চি ও তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতা এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টের বিরুদ্ধে করা রাষ্ট্রদ্রোহ অভিযোগের বিচার শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
২০১০ সালে মুক্তির আগে তৎকালীন সেনা সরকারের আমলে ১৫ বছরের বেশি সময় গৃহবন্দি ছিলেন দেশটির গণতন্ত্রকামী নেতা সু চি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/ ১৩৩৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ