হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি এক মাসের বেশি আগে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। বিলুপ্তির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সাবেক আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে আহ্বায়ক ও সাবেক মহাসচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদী সদস্যসচিব করে বয়োজ্যেষ্ঠ আরও ৩ সদস্য নিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি গঠনের এক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর সংগঠনটির কার্যক্রম নিয়ে ফের শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন। রাজনৈতিক পরিচয়ধারী নেতাদের বাদ দিয়ে খুব শিগগিরিই নতুন কমিটি ঘোষণা করছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
জানা যায়, হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটি করছেন জুনায়েদ বাবুনগরী। যেখানে প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর বড় ছেলে মো. ইউসুফকেও রাখা হচ্ছে। এদিকে আহমদ শফীর ছোট ছেলে আনাস মাদানিপন্থীরাও প্রস্তুতি নিচ্ছে হেফাজতের পাল্টা কমিটি গঠনের।
হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ বলেন, বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির পরিধি বাড়ানো হবে। নতুন করে ৫-৭ জন নেতা যুক্ত করে কমিটি ১০-১২ সদস্যের করা হবে বলে এমন পরিকল্পনার বিষয়টি একটি সূত্র নিশ্চিত করলেও ভিন্ন এক সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ও বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে খুব শিগগিরই ঘোষণা করা হবে নতুন কমিটি। এক্ষেত্রে প্রয়াত আল্লামা আহমদ শফীর পুত্র মাওলানা আনাস মাদানীর অনুসারীদের কয়েকজন হেফাজতের নতুন কমিটিতে ঠাঁই পেতে পারেন।
হেফাজতের শীর্ষ পদে থাকা এক নেতা নাম প্রকাশ না করা শর্তে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বিতর্কিত নেতাদের বাদ দিয়ে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরাসরি রাজনৈতিক দলের পদে আছেন এমন কাউকে খসড়া কমিটিতে রাখা হয়নি।
ওই খসড়া কমিটিতে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির এবং আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদীকে মহাসচিব হিসেবে রাখা হয়। ওই কমিটির বর্তমান পরিধি ৩০-৩৮ সদস্যবিশিষ্ট হতে পারে। অচিরেই এ নতুন কমিটির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে। তবে তৈরি করা খসড়া কমিটি নিয়ে হেফাজত সংশ্লিষ্টরা প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি নন।
হেফাজতের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির ও নুরুল ইসলাম জেহাদিকে মহাসচিব করে হেফাজতের নতুন কমিটি করা হচ্ছে। তবে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে মীর ইদ্রিস ও প্রচার সম্পাদক পদে মহিউদ্দিন রাব্বানীকে রাখা হয়েছে। মীর ইদ্রিস বিলুপ্ত কমিটিতে যুগ্ম মহাসচিব, আর মহিউদ্দিন রাব্বানী কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। মহিউদ্দিন রাব্বানী সংবাদ মাধ্যমে বলেন, তাকে প্রচার সম্পাদক পদে রাখা হচ্ছে এমন তথ্য তিনি এখনো জানেন না।
কমিটিতে মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, মাওলানা সালাউদ্দিন নানুপুরী, অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান, মাওলানা মুহিব্বুল হক (সিলেট), মাওলানা উবায়দুর রহমান মাহবুব (বরিশাল) কয়েকজনকে নায়েবে আমির হিসেবে রাখা হয়েছে।
যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে রয়েছেন- মাওলানা সাজিদুর রহমান (বি-বাড়িয়া), মাওলানা আবদুল আউয়াল (নারায়নগঞ্জ) ও মাওলানা আরশাদ রহমানী (বসুন্ধরা)।
কমিটি থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছেন সদ্য বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, নাছির উদ্দিন মুনির, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, কেন্দ্রীয় নেতা জাকারিয়া নোমান ফয়জী, খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, হাসান জামিল, মুফতি হারুন ইজহারসহ নানা ইস্যুতে বিতর্কে জড়িয়ে পড়া হেফাজতের নেতারা।
একইভাবে আল্লামা আহমদ শফীর হত্যা মামলার অভিযুক্ত নেতাদেরও বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সদ্য বিলুপ্ত কমিটিতে একক আধিপত্য বিস্তারকারী ‘রাবেতা’ ও ‘জমিয়ত’ সিন্ডিকেটও ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, নতুন কমিটিতে হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা আহমদ শফীর অনুসারী বেশ কয়েকজনকে আবারও রাখা হয়েছে।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির করে ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট হেফাজতের কমিটি ঘোষণা করা হয় সেখানে হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফীর অনুসারী কাউকে রাখা হয়নি। পরে রাখার কথা থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে আল্লামা শফি’র পুত্র আনাস মাদানীর মোবাইলফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে মাওলানা আনাস মাদানীর এক অনুসারী এক সংবাদ মাধ্যমকে জানান, তাদের সঙ্গে আহ্বায়ক কমিটির কোন নেতা এখনও পর্যন্ত যোগাযোগ করেননি। নতুন কমিটিতে তাদের রাখা হলে তারা থাকবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসলে পরে তা আমাদের জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এদিকে জুনায়েদ বাবুনগরীদের পাল্টা কমিটি গঠনের জন্য আনাস মাদানির অনুসারীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। তবে কমিটি গঠনের আগে তারা শাহ আহমদ শফীর ‘মৃত্যুর’ ইস্যু নিয়ে সোচ্চার হবেন। এ বিষয়ে আজ বুধবার বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘শাহ আহমদ শফী (রহ.)–এর হত্যা মামলায় অভিযুক্তদের ও উসকানিদাতাদের গ্রেপ্তারপূর্বক বিচারকার্য দ্রুত সম্পন্ন করার দাবিতে’ সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে। এ ব্যাপারে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় আনাস মাদানি, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মঈনুদ্দীন রুহী, মাওলানা সলিমুল্লাহসহ কয়েকজন আলেম বৈঠক করেছেন।
মঈনুদ্দীন রুহী গতকাল জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, ‘আমরা কমিটি গঠনে একটু সময় নিচ্ছি। ওদেরটা প্রকাশ করুক, তারপর আমরা ঠিক করব, আমাদেরটা কখন ঘোষণা করা হবে।’ রুহী হেফাজতের প্রথম কমিটিতে যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আনাসপন্থীরা এত দিন কমিটি করার জন্য প্রত্যাশা অনুযায়ী লোক না পেলেও এখন অনেককে পাচ্ছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমনকে কেন্দ্র করে গত মার্চের ২৫, ২৬ ও ২৭ তারিখ দেশজুড়ে যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে, অন্তত ১৭ জন মানুষের প্রাণহানি হয়। এসব নাশকতার পেছনে জড়িত থাকার অভিযোগে অন্তত এক ডজন হেফাজত নেতা গ্রেপ্তার রয়েছেন।
এর মধ্যে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে রয়্যাল রিসোর্টে নারীসহ জনতার হাতে ধরা পড়েন। এতে নতুন করে বিতর্কের মুখে পড়ে হেফাজত।
সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে কোণঠাসা হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতারা শুরু থেকেই সমঝোতার চেষ্টা করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তারা গোয়েন্দা সংস্থা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হেফাজতে ইসলামের এক নেতা বলেন, সর্বশেষ কমিটিতে মামুনুল হক ও জমিয়ত এককভাবে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। যা নিয়ে বাবুনগরীকে বেশ বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। পরে মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ডের পর একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে ওই কমিটি বিলুপ্ত করে তিনি। নতুন কমিটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে নানামুখী চাপে রয়েছেন বাবুনগরী। তাই রাজনৈতিক পদধারী নেতাদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করছেন তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ