আগে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সাথে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বিভিন্ন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে দেখা যেত। এখন দেশে বিরোধী দল নেই বললেই চলে। একইসাথে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদেরও তেমন উচ্চবাচ্চ শোনা যায় না। তবে দেশে বিরোধী দল না থাকলেও সংঘর্ষ থেমে নেই। ক্ষমতাসীন দলের দুই গ্রুপের মধ্যে এখন সংঘর্ষের ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রায় নিয়মিতই আসে। আজ তেমনি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে ২ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। গত কয়েকদিন ধরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটেই যাচ্ছে।
বরিশালে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত ২
বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুজন নিহত হয়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে উপজেলার উত্তর উলানিয়া ইউনিয়নের সলদি লক্ষীপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এসময় আরও অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন।
সংঘর্ষে নিহতরা হলেন- ছত্তার ঢালী (৪৫) ও সিদ্দিকুর রহমান (২৭)।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ধূলখোলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি কালাম বেপারী ও ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক জামাল রাঢ়ীর মধ্যে উলানিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলছিল। তারই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার সকালে দুই পক্ষের মধ্যে লাঠিসোটা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই মারা যান আওয়ামী লীগের কর্মী সিদ্দিকুর রহমান। গুরুতর আহত অবস্থায় সাত্তার ঢালীকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেছেন।
মেহেন্দিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম জানিয়েছেন, সংর্ঘষের ঘটনায় তিন জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
সোনাতলায় আ.লীগের ২ পক্ষের সংঘর্ষে আহত ৫
বগুড়ার সোনাতলায় উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে কমপক্ষে পাঁচ জন আহত হয়েছেন।
বুধবার বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত উপজেলার রেলগেট এলাকায় বগুড়া-১ আসনের (সারিয়াকান্দিা ও সোনাতলা উপজেলা) সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নান শিল্পীর উপস্থিতিতে মিনহাদুজ্জামান লীটন ও জাকির হোসেন পক্ষের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ।
মিনহাদুজ্জামান লীটন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। অন্যদিকে জাকির হোসেন উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক।
সংঘর্ষ চলার সময় সাংসদ সাহাদারা মান্নান ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ চার রাউন্ড টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল বিকেলে সোনাতলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে দলের বর্ধিত সভা ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সাংসদ সাহাদারা মান্নান। তবে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রকে এই সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এতে তাদের সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা তৈরি হয়। তারা উপজেলা সদরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জাকির হোসেনের কার্যালয়ে জড়ো হতে থাকেন।
এ খবর মিনহাদুজ্জামান লীটনের সমর্থকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজনা দেখা দেয়। এ সময় মিনহাদুজ্জামান তার সমর্থকদের নিয়ে জাকিরের কার্যালয়ে গেলে হট্টগোল শুরু হয়। একপর্যায়ে হাতাহাতি থেকে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের চারটি শেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনহাদুজ্জামান লীটন বলেন, ‘উপজেলার দলীয় কার্যালয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে স্থানীয় সাংসদ সাহাদারা মান্নান শিল্পীকে প্রধান অতিথি করা হয়েছিল। এছাড়াও অনুষ্ঠানে প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের উপস্থিতিত থাকতে বলা হয়। ’
তিনি বলেন, ‘অনুষ্ঠান শুরুর আগে শুনতে পাই ভাইস চেয়ারম্যান জাকির হোসেন তার বাহিনী নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে অবস্থান নিয়েছেন। আমি তাদের কাছে গিয়ে বিশৃঙ্খলা করতে নিষেধ করি। এতে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা আমাদের নিজস্ব অফিসে বসে ফুটবল খেলা দেখছিলাম। এমন সময় উপজেলা চেয়ারম্যান তার লোকজন নিয়ে অতর্কিতভাবে আমাদের উপর হামলা চালায়। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।’
সোনাতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম রেজা বলেন, ‘আসলে কী নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ সেটি জানা নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চার রাউন্ড টিয়ারসেল নিক্ষেপ করা হয়। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।’
ফরিদপুরে আ. লীগের ২ পক্ষের সংঘর্ষে ৭ পুলিশসহ আহত অন্তত ২৫
ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সমর্থকদের সংঘর্ষে পুলিশসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন।
বুধবার সকালে উপজেলার পরমেশ্বরদী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১৮ জনকে আটক করেছে পুলিশ। বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পরমেশ্বদী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ও ময়েনদিয়া গ্রামের বাসিন্দা মান্নান মাতুব্বরের সঙ্গে একই ইউনিয়নের পরমেশ্বদী গ্রামের বাসিন্দা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি মাসুদ শেখের মধ্যে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। এ বিরোধকে কেন্দ্র করে বুধবার ভোর ৬টার দিকে দুই পক্ষের লোকজন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এ সংঘর্ষের ঘটনায় সাত পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ২৫ আহত হয়েছেন জানিয়ে বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক কে এম মাহমুদুল রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সাত পুলিশ সদস্যকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। ২৫ জনের মধ্যে চার জন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি আছেন। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।’
এ ব্যাপারে মান্নান মাতুব্বর বলেন, পূর্বশত্রুতার জেরে সকালে মাসুদের লোকজন আমার পক্ষের লোকদের বাড়িঘর ভাংচুর করে। বিষয়টি আমি আঁচ করতে পেরে বোয়ালমারী ও সালথা থানা পুলিশকে জানাই।
এদিকে মাসুদ শেখ বলেন, মান্নান মাতুব্বরের সঙ্গে না থাকায় তিনি প্রায়ই আমার লোকদের লাঞ্ছিত করেন। সকালে মান্নান মাতুব্বরের লোকজন আমার লোকদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে বাড়িঘর ভাংচুর করে।
বোয়ালমারী থানার ওসি মোহাম্মদ নুরুল আলম বলেন, সংঘর্ষের সময় ঘটনাস্থল থেকে ১৮ জনকে আটক করা হয়েছে। এখনো কোনো পক্ষের লিখিত অভিযোগ পাইনি। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ক্ষমতায় থাকলে দল বড় হতে থাকে। ক্ষমতার মোহে দল যত বড় হবে, হানাহানি তত বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। তার ওপর ক্ষমতাসীন দলের অংশ হলে আইনি প্রক্রিয়া ঠিকভাবে চলে না। দল থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে—এমন নজিরও খুব একটা পাওয়া যায় না। মাঠে যেহেতু অন্য কেউ নেই, তাই নিজেদের মধ্যেই একে অপরকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।
তারা বলেন, ‘সরকারি দল হলে সাত খুন মাফ, এটা তো কথার কথা নয়। বাস্তবেও ঘটছে।’
তারা বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতির মূল কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফায়দা দেওয়া ও নেওয়া। বর্তমান সরকার দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে নতুন নতুন ফায়দা নেওয়ার লোক তাদের দিকে ঝুঁকছে। ফলে প্রতিযোগিতাটা বেড়ে গেছে। যার ফলাফল হচ্ছে নিজেদের মধ্যে সংঘাত ও প্রাণহানি।
তারা বলেন, ফায়দা নেওয়া রাজনীতিকদের কেউ কেউ এখন নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও এসেছেন। আর এখন যারা ফায়দা নিচ্ছেন, তারাও হয়তো একদিন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যাবেন। তখন পরিস্থিতি কী হবে, ভাবতে গেলেও ভয় লাগে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ