২০১৬ সালের মার্চে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে নারদ ডট কম নামের একটি নিউজ পোর্টালে তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের ঘুষ নেওয়ার এক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়। এটাই নারদ কেলেঙ্কারি হিসাবে আলোচিত হয়। সম্প্রতি নারদ মামলার আসামি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের নগর উন্নয়ন ও পৌরসভা মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, বিধায়ক (বিধানসভার সদস্য) মদন মিত্র ও বিধায়ক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেপ্তার করে সিবিআই। এবার আসামির তালিকায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক ও দলটির নেতা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম যুক্ত করা হয়েছে।
ভারতের তদন্তকারী সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) এ তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে মামলাটি পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে স্থানান্তর করার আরজি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন করেছে সিবিআই।
হাইকোর্টে সিবিআই জানিয়েছে, সোমবার পরিকল্পিতভাবে সিবিআই অফিস ঘেরাও করা হয়। সিবিআই অফিসে ৬ ঘণ্টা ধর্ণা দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিন মুখ্যমন্ত্রী সিবিআই অফিসে এসে চিৎকার করে অভিযুক্তদের ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন, এমনকি নইলে তাকে গ্রেপ্তার করার দাবি জানান।
সিবিআই আদালতে দাবি করেছে, সেদিন তাদের বিরুদ্ধে মামলা করারও হুমকি দেওয়া হয়। এই সমস্ত ঘটনা আদালতের সামনে তুলে ধরেই সিবিআই মামলা অন্যরাজ্যে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিবেদন দিয়েছে। তাদের আশঙ্কা, এরাজ্যে মামলা চললে তাদের কাজ বাধা প্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলাও ভেঙে পড়বে।
এর আগে গত সোমবার (১৭ মে) সকাল ১০ টার দিকে নারদ দুর্নীতি মামলার আসামি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের নগর উন্নয়ন ও পৌরসভা মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, বিধায়ক (বিধানসভার সদস্য) মদন মিত্র ও বিধায়ক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেপ্তার করে সিবিআই।
তাদের গ্রেপ্তারের এক ঘণ্টার মধ্যেই বেলা ১১টার দিকে সিবিআই কার্যালয়ে যান তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে এই গ্রেপ্তার প্রক্রিয়াকে ‘বেআইনি’ বলে দাবি করেন তিনি। পাশাপাশি তাকে গ্রেপ্তার করতেও সিবিআই কর্মকর্তাদের চ্যালেঞ্জ জানান তৃণমূল সভানেত্রী।
আদালতে এদিন নারদের জো়ড়া মামলা শুনানি। একটি নারদ মামলা অন্যরাজ্যে স্থানান্তরের জন্য সিবিআইয়ের আবেদন, অন্যদিকে নারদে অভিযুক্ত চার নেতা মন্ত্রীর জামিনে স্থগিতাদেশের আর্জি পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানি।
নারদ মামলায় গ্রেপ্তার চার নেতা-মন্ত্রীর জামিনের নির্দেশ সোমবার কলকাতা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দলের ডিভিশন বেঞ্চ স্থগিত করে দিয়েছিলেন। মঙ্গলবার সেই স্থগিতাদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন নিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির এজলাসেই আবেদন করেন অভিযুক্ত চারজনের আইনজীবীরা। বুধবার দুপুর ২ টায় আবেদনের শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
তৃণমূলের গ্রেপ্তার চার নেতা কে কেমন আছেন?
নারদ মামলার জের ধরে হাইকোর্টের নির্দেশে জেল হেফাজতে রয়েছেন তৃণমূলের চার হেভিওয়েট নেতা। তৃণমূলের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, বিধায়ক মদন মিত্র, শোভন চট্টোপাধ্যায়কে গেল সোমবার গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও ফিরহাদ ছাড়া বাকি তিন নেতা এখন রয়েছেন এসএসকেএম হাসপাতালে।
তিনজন হাসপাতালে থাকলেও প্রেসিডেন্সি জেলের সেলেই রয়েছেন ফিরহাদ হাকিম। গতকাল সারা দিন জ্বর ছিল ফিরহাদের। এরপর রাত ৯টা ১৫ মিনিটে তার দুই মেয়ে ও স্ত্রী গিয়েছিলেন দেখা করতে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে যেতে বলা হলেও যাননি ফিরহাদ। জেলের চিকিৎসকরাই তাকে দেখভাল করছেন।
অপরদিকে, একবার এসএসকেএম থেকে জেলে ফিরে ফের হাসপাতালেই যেতে হয়েছে সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে। তবে এই মুহূর্তে তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এদিকে কয়েক দিন আগে করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর মদন মিত্র ফের অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। করোনা-পরবর্তী সমস্যার কারণে তাকে হাসপাতালে অক্সিজেন সাপোর্টে রাখা হয়েছে।
তৃণমূলে না থাকলেও নারদ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া শোভন চট্টোপাধ্যায়ও হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। ডায়াবেটিস ও সিওপিডির সমস্যায় ভোগা শোভন বর্তমানে স্থিতিশীল আছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল।
নারদ কেলেঙ্কারি কী?
২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে কলকাতায় আসেন সাংবাদিক ম্যাথু স্যামুয়েল। পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসা করতে ইচ্ছুক বলে জানিয়ে তৃণমূলের প্রভাবশালী কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় নির্বাচনের আগে তাদের হাতে টাকা তুলে দেন এবং সেই লেনদেনের ছবি লুকিয়ে তুলে নেন মোবাইলের ক্যামেরায়।
পরে ২০১৬ সালে নারদা ডট কম নামের একটি নিউজ পোর্টাল তৃণমূল কংগ্রেসের কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় নেতা, মন্ত্রী এবং কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের ঘুষ নেওয়ার ভিডিও প্রকাশ করে। এই ঘটনায় সে সময় ভারতজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। এরপর তৃণমূলের বহু নেতা, সাংসদ এবং মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন করে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই।
২০১৬ সালের মার্চে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের ঘুষ নেওয়ার এক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়। তা নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১৭ সালে মার্চে এই নারদা কেলেঙ্কারি মামলার তদন্তের ভার দেওয়া হয় ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআইকে। যদিও ২০১৬ সালে এই নারদা স্টিং অপারেশনের তথ্য ফাঁস হওয়ার পর প্রথম এই মামলার তদন্ত ভার গ্রহণ করে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট—ইডি।
সেই মামলায় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন চার মন্ত্রীসহ অন্য তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের আসামি করা হয়। কিন্তু মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে মামলা চালাতে গেলে রাজ্যপালের অনুমতির প্রয়োজন হয়। সেই লক্ষ্যে সিবিআই রাজ্যপালের কাছে অনুমতি চাইলে দীর্ঘদিন পর রাজ্যপাল এই চার নেতার বিরুদ্ধে মামলা চালানোর অনুমতি দেন সংবিধানের ১৬৩ ও ১৬৪ ধারামতে।
নারদকাণ্ডে কারা জড়িত?
ক্যামেরায় যাদের ঘুষ নিতে দেখা গিয়েছে, তারা হলেন প্রাক্তন তৃণমূল নেতা তথা বর্তমান বিজেপি সর্বভারতীয় সহ সভাপতি মুকুল রায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সুলতান আহমেদ, সৌগত রায়, শুভেন্দু অধিকারী, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভন চট্টোপাধ্যায়, মদন মিত্র, ইকবাল আহমেদ, ফিরহাদ হাকিম, পুলিশ আধিকারিক এমএইচ আহমেদ মির্জা।
নারদ মামলা কীভাবে এগিয়েছে?
নারদ স্টিং অপারেশনের ফুটেজ ঘিরে বিতর্ক সত্ত্বেও ২০১৬ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতা ধরে রেখেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। চলতি বছরের ১৭ মার্চ কলকাতা হাইকোর্ট তদন্তের নির্দেশ দেয়। এই মামলায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে সিবিআইকে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশের আর্জি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু, শীর্ষ আদালতে ভর্ৎসনার মুখে পড়ে মমতা সরকার। তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত। সেই সঙ্গে সিবিআইকে এক মাস সময় দেয় তদন্ত চালানোর জন্য। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা রুজুর জন্য রাজ্যপালের অনুমোদন চায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দল। রাজ্যপালের অনুমোদনের পরই পদক্ষেপ করল সিবিআই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০২
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ