চীনের এক দশক ধরে থাকা বিতর্কিত ‘এক সন্তান’ নীতির পরিবর্তন হয় ২০১৬ সালে। ভবিষ্যতে দেশটির কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় তখন দুই সন্তান নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু এরপরও আশানুরূপ হারে জনসংখ্যা বাড়েনি। চীনের জনসংখ্যা রেকর্ড হারে কমছে। কমার হারটা এতই যে নামতে নামতে গত কয়েক দশকের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছে।
আজ মঙ্গলবার(১১ মে) চীনা সরকার কর্তৃক প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়,, বিগত দশ বছরে দেশটিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল দশমিক শূন্য ৫৩ শতাংশ। ২০০০ এবং ২০১০ সালে এই হার শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশের নিচে নেমেছিল। দেশটির বতর্মান জনসংখ্যা ১৪১ কোটিতে পৌঁছেছে।
বিবিসি লিখেছে, এই হিসাব চীনের নীতি নির্ধারকদের চিন্তায় ফেলছে। দম্পতিদের সন্তান নেয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে উৎসাহ দেয়ার তাগিদ সরকারের পক্ষ থেকে আসবে কি না, সেটি ভাবার সময় এসেছে।
দ্য গার্ডিয়ান বলছে, চীনে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৯৬০ এর দশকের পর গত দশকে ছিল সবচেয়ে কম।
২০২০ সালের শেষ দিকে এই আদমশুমারিটি করা হয়েছিল। ৭০ লাখ আদমশুমারি গ্রহণকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই সব তথ্য সংগ্রহ করে। ধারণা করা হচ্ছে, এই জরিপটি দেশটিতে জনসংখ্যা সম্পর্কিত আগামী পরিকল্পনায় কী পদক্ষেপ নেওয়া যাবে তাতে কাজে লাগবে।
বিশ্লেষকদের বলছেন, চাকরি ও স্বাধীনতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া এবং জীবনধারণের খরচ বেশি হওয়ার কারণে চীনে দম্পতিদের মধ্যে সন্তান জন্মদানে আগ্রহ কম বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, দেশ উন্নত হওয়ার সাথে সাথে শিক্ষা বা ক্যারিয়ারের মতো অন্যান্য অগ্রাধিকারের কারণে জন্মের হার হ্রাস পায়।
উদাহরণস্বরূপ— চীনের প্রতিবেশী জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও দম্পতিদের আরও বেশি সন্তান নিতে সরকার নানা কর্মসূচি নিয়েছে। এরপরও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওই দুই দেশে জন্মহার কমেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে গত বছর প্রথমবারের মতো জন্মের চেয়ে বেশি মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে। ফলে, বিশ্বের সর্বনিম্ন জন্মহারের দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
জন্মহার কমে যাওয়ার ঘটনা বেইজিংয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে উল্লেখ করে দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনসংখ্যা হ্রাস এড়াতে কীভাবে দম্পতিদের আরও বেশি সন্তান নিতে আগ্রহী করে তোলা যায় এ নিয়ে নতুন করে ভাবছে বেইজিং।
জনসংখ্যার হার কমে গেলে একটি দেশে বয়স্ক ব্যক্তিদের তুলনায় তরুণদের সংখ্যা কম হয়, যা সমাজ কাঠামোর জন্য সমস্যা-সঙ্কুল। এমনটি ঘটলে ভবিষ্যতে প্রবীণদের সহযোগিতা করার জন্যে পর্যাপ্ত কর্মী পাওয়া যাবে না।
জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রধান নিং জিঝে সাংবাদিকদের বলেন, চীনের প্রজনন নীতিতে যে সমন্বয় আনা হয়েছে, তা ইতিবাচক ফল এনেছে। তবে তিনি এ–ও বলেন, বয়স্ক লোকজন বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি জনসংখ্যা উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি চাপ সৃষ্টি করছে।
তিনি বলেন, চীনের জনসংখ্যা সামনেই চূড়ার সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছাবে, যদিও ঠিক কবে পৌঁছাবে তা অনিশ্চিত। ধারণা করা হচ্ছে যে, নিকট ভবিষ্যতেও জনসংখ্যা ১৪০ কোটির বেশিই থাকবে।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়, আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী লোকজনের সংখ্যা সাত শতাংশ কমে গেছে। অন্যদিকে ষাটোর্ধ্বদের সংখ্যা ৫ শতাংশ বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটিতে বিয়ের হার অনেক কমে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে জন্মহারের ওপর। একই সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি, নারীদের দেরিতে সন্তান নেওয়া বা সন্তান নেওয়ায় অনীহার বিষয়গুলোকে জন্মহার কমে যাওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
নিং জিঝে আরও বলেন, করোনা মহামারিও একটি কারণ হতে পারে। তিনি বলেন, করোনা জীবনের প্রতিটি দিনকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এ অবস্থায় হাসপাতালে সন্তান জন্ম দেওয়া নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এর ফলে দম্পতিদের মধ্যে সন্তান নেওয়ার আগ্রহ অনেক কমে গেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমও জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার কথা ধারাবাহিকভাবে জানিয়ে যাচ্ছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী আগামী কয়েক বছরের মধ্যে চীনের মূল ভূখণ্ডে জনসংখ্যা সংকুচিত হওয়া শুরু করতে পারে।
জাতিসংঘের অনুমান, চীনের মূল ভূখণ্ডের জনসংখ্যা ২০৩০ সালে শিখরে পৌঁছাবে, এরপর থেকে নামতে শুরু করবে।
এপ্রিলের শেষদিকে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস এ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অজ্ঞাত কয়েকজনকে উদ্ধৃত করে ২০২০ সালে চীনের জনসংখ্যা আগের বছরের তুলনায় কমেছে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু আদমশুমারির ফলাফল তাদের দেওয়া তথ্যকে সমর্থন করছে না।
এবারের আদমশুমারিতে একটি ইতিবাচক প্রবণতাও দেখছে দেশটি। ২০২০ সালে দেশটির মোট জনসংখ্যায় ১৪ বা তার কম বয়সীর পরিমাণ দেখা গেছে ১৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ; ২০১০ সালেও যা ছিল ১৬ দশমিক ৬।
আর সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে জন্মহার। ২০১৬ সালে এক সন্তান নীতি রদ করার পর ওই বছর বাদে ২০১৯ পর্যন্ত দেশটিতে জন্মহার না বেড়ে উল্টো কমেছে।
গত বছর দেশটিতে এক কোটি ২০ লাখ শিশুর জন্ম রেকর্ড করা হয়েছে, ২০১৯ সালেও এ সংখ্যা এক কোটি ৪৬ লাখের বেশি ছিল, জানিয়েছেন নিং।
দেশটিতে ২০২০ সালের হিসাবে ৬৫ বা তার চেয়ে বেশী বয়সী নাগরিকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ, যা এক দশক আগের ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশের চেয়ে অনেকটাই বেশি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ