সুমিত রায়
পারস্যের রাজপুত্র সাইরাস দ্য ইয়ংগার যেমনটা চেয়েছিলেন তাই হলো। তার কাছে যেন একেবারে ঠিক সময়টাতেই এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যকার সুদীর্ঘ ২৮ বছরব্যাপী পেলোপনেসীয় যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল। সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ৪০৪ অব্দের ২৫শে এপ্রিল। এই পেলোপনেসীয় যুদ্ধ শুধু গ্রিসের ইতিহাসই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এক টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে সামনে আসে, এটি ইতিহাসের চেনা জানা সরলপথকে আটকে দিয়ে পুরো মোড়টাকেই ঘুরিয়ে দেয়। ভূমিতে স্পার্টানরা অপ্রতিহত হলেও সমুদ্রে শ্রেষ্ঠ এথেনীয়দেরকে পরাজিত করা স্পার্টানদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। এর জন্য তাদের দরকার ছিল এথেন্সের মতই শক্তিশালী নৌবাহিনী। আর সেই নৌবাহিনী গঠনের জন্য দরকার প্রচুর অর্থের। এথেন্স তার বাণিজ্যিক আধিপত্যের জন্য যেরকম বিত্তশালী হতে পেরেছিল স্পার্টা তা পারেনি। স্পার্টাকে আর্থিক সাহায্য করে জয়ের পথ দেখায় পারস্য। ৪৯৯ থেকে ৪৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ঘটা গ্রেকো-পারশিয়ান যুদ্ধে পরাজয়ের স্মৃতি পারস্য ভুলে যায়নি। তার প্রতিশোধ নিতে তারা সবসময়ই বদ্ধপরিকর ছিল, কেবল উপযুক্ত সুযোগেরই অপেক্ষা। সুযোগটা নিয়ে এসেছিল পেলোপনেসীয় যুদ্ধ। ৪২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্বিতীয় দারিউস পারস্যের সিংহাসনে বসেই গ্রিসের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করতে থাকেন, তখন সমগ্র গ্রিসে পেলোপনেসীয় যুদ্ধের আগুন জ্বলছে। পুরো গ্রিস এথেন্স ও স্পার্টা নামক দুটো শিবিরে বিভক্ত। এবারে প্রথম দারিউসের মত দ্বিতীয় দারিউস আর সম্মুখ সমরে তাদেরকে পরাজিত করতে চাইলেন না। এবারে তার কার্যপ্রক্রিয়া ছিল আরও বেশি মারাত্মক, আরও বেশি রক্তক্ষয়ী। তিনি অর্থের সাহায্যে যুযুধান গ্রিকদেরকে একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে তাদেরকে দুর্বল করে দিতে চেয়েছিলেন। আর সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে পাঠিয়েছিলেন নিজ পুত্র সাইরাস দ্য ইয়ংগারকে। এই রাজকুমার সাইরাসই আর্থিক সহায়তা দান করে স্পার্টানদেরকে শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করিয়ে দেন। যার ফলেই স্পার্টানরা এথেন্সের সাথে সমানে সমানে নৌযুদ্ধ করতে থাকে, আর এথেনীয়দের বড় দুটি ব্লান্ডারকে ঠিকমত নিজেদের পক্ষে কাজে লাগিয়ে ঈগোস্পটামির নৌযুদ্ধে এথেনীয় নৌবাহিনী কফিনে শেষ পেড়েকটি ঠুকে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানে। যুদ্ধে স্পার্টার জয় হয়, আর সমগ্র গ্রিক জগৎ জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় “স্পার্টান হেজিমনি”।
তবে সাইরাস কিন্তু স্পার্টানদেরকে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করেননি। তার মাথায় কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল। আর এই পরিকল্পনাকে সার্থক করার জন্য তার কিছু নির্ভরযোগ্য গ্রিক সৈন্যের দরকার ছিল। তার পিতা দ্বিতীয় দারিয়ুস তাকে গ্রিসের যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে পাঠিয়েছিল, যাতে এর মাধ্যমে দুর্বল গ্রিসের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৪০৪ অব্দে এথেন্সের আত্মসমর্পণের বছরেই দ্বিতীয় দারিউসের মৃত্যু হয়। তার পরিকল্পনামাফিক আর পারসিকদের এগোনো হয়নি। কিন্তু এবার সাইরাস দ্য ইয়ংগার এক নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এই যুদ্ধের ফল ভোগ করতে চাইলেন। দ্বিতীয় দারিউসের মৃত্যুর পর পারস্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন সাইরাসেরই বড় ভাই। দ্বিতীয় আরতাজারেক্সেস নাম নিয়ে তার রাজ্যাভিষেক হয়েছে। কিন্তু কোন চ্যালেঞ্জ ছাড়াই আরতাজারেক্সেস তদকালীন বিশ্বের সবচাইতে ক্ষমতাধর আসনটি কব্জা করবেন, এটা সাইরাস কিছুতেই মেন নিতে পারেননি। তিনি পারস্যের সিংহাসন লাভের জন্য তার ভাইকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন ও সেই উদ্দেশ্যে সৈন্য জোগাড় করা শুরু করেন। তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন যে, পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রিক হপলাইটদের জোগাড় করতে পারলে তাদের দিয়ে এশীয় বাহিনীকে পরাজিত করে পারস্য সাম্রাজ্যকে কব্জা করা কঠিন হবেনা। উল্লেখ্য, সে সময়ে গ্রিক সৈন্যরাই ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শক্তি, পারস্য সহ এশিয়ার কোন শক্তিই তাদের সামনে টিকতে পারত না। আর ভূমিতে স্পার্টানরা তো ছিল সেরাদের সেরা। সেনাবাহিনী গঠনে সাইরাসকে বেগ পেতে হলো না। তার সাথে স্পার্টার লাভজনক চুক্তি হয়েছিল, আর পারস্যের সিংহাসনে একজন স্পার্টা-পক্ষীয় শাসক বসলে তাদেরই লাভ ছিল। তাই স্পার্টাও সাইরাসের পরিকল্পনামাফিক কাজই করল। এদিকে সে সময়ে গ্রিসের প্রজন্মটি ছিল সৈন্যতে ভরপুর, পেলোপনেসীয় যুদ্ধের জন্যই এই প্রজন্মকে সৈন্য হিসেবে দীক্ষিত করা হয়েছে। সৈন্যের জীবিকা ছেড়ে নাগরিক জীবনে ফিরে যাবার কোন ইচ্ছা এদের ছিলনা। যুদ্ধের ফলে গ্রিসের নগরগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, এরা সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরেও অভ্যস্ত হতে চায়নি। তাই যারা তাদেরকে অর্থ দিতে পারবে তাদেরকে সামরিক সেবা দিতে তারা আগ্রহী ছিল। সাইরাস ১০,০০০ এরও বেশি গ্রিক সৈন্য ভাড়া করলেন। লােকমুখে এরা পরবর্তীতে “দশ হাজার” বা “টেন থাউস্যান্ড” নামে পরিচিত হয়। এদের নেতৃত্বে ছিলেন স্পার্টান সেনাপতি ক্লিয়ারকাস। পদপ্রাপ্ত বা র্যাংকপ্রাপ্ত সৈন্যদের মধ্যে একজন এথেনীয়ও ছিলেন। তিনি ছিলেন জেনোফোন, যিনি ছিলেন সক্রেটিসের একজন অনুগত শিষ্য।
খ্রিস্টপূর্ব ৪০১ অব্দের বসন্তে এই টেন থাউস্যান্ড এশিয়া মাইনর থেকে ইসুসের উপসাগর পর্যন্ত অগ্রসর হলো। জায়গাটা ছিল ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে উত্তর-পূর্বের কোনা। সাইরাস ক্লিয়ারকাস ছাড়া এই টেন থাউস্যান্ডের কাউকেই তার পরিকল্পনার ব্যাপারে জানায়নি, তারা জানতই না যে তারা গ্রিসের কোথাও লড়তে যাচ্ছে না, বরং যাচ্ছে সুদূর পারস্যে। কিন্তু এখন তারা যে পথ ধরে যাচ্ছিল তার ফলে বাহিনীর সবচেয়ে বোকা সৈন্যটিও বুঝে ফেলেছিল যে তারা তাদের চেনা গ্রিক জগৎ ছেড়ে অজানা পারস্যের দিকে যাচ্ছে। এই অবস্থায় কেবল হুমকি বা মিষ্টি কথা বা আরও বেশি অর্থ দিয়েই তাদেরকে অগ্রসর করানো যেত। শেষ পর্যন্ত তারা রাজি হলো। তারা ইউফ্রেতিস নদীর কাছে পৌঁছে গেল এর তীর বরাবর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ৫০০ মাইলেরও বেশি অগ্রসর হয়ে ৪০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের গ্রীষ্মে কিউনাক্সা (Cunaxa) নগরে পৌঁছে গেল, যা ছিল ব্যাবিলন থেকে ৮৭ মাইল উত্তর-পশ্চিমে। সেখানে সাইরাস দ্য ইয়ঙ্গারকে প্রতিহত করার জন্য তদকালীন পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় আরতাজারেক্সেসের অনুগত সেনাবাহিনীকে নিয়ে আসা হয়েছিল। সাইরাসের একটা উদ্দেশ্যই ছিল, আর তা হলো তার ভাই দ্বিতীয় আরতাজারেক্সেসের মৃত্যু। কিন্তু তার ভাইয়ের সেনাবাহিনী নিয়ে তার কোন সমস্যা ছিলনা, কেননা তিনি তার ভাইকে হত্যা করে একবার পারস্যের সিংহাসনে বসলে এই অনুগত সেনাবাহিনী তাকেই সম্রাট হিসেবে মেনে নেবে। তাই তিনি স্পার্টান সেনাপতি ক্লিয়ারকাসকে এই সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে না জড়িয়ে সরাসরি পারস্যের কেন্দ্রে গিয়ে আরতাজারেক্সেসকে আক্রমণ করতে রাজি করানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু একজন আদর্শ স্পার্টানের মত ক্লিয়ারকাসও ছিলেন সাহসী ও বোকা। তিনি সাইরাসের এই প্রস্তাব মেনে নিলেন না। তিনি গোঁ ধরলেন, যুদ্ধ তিনি অর্থোডক্স স্পার্টান কায়দাতেই করবেন, প্রতিপক্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাদলকে ঘায়েল করেই তিনি বিজয় অর্জন করবেন। ফলে যা হবার তাই হলো, যুদ্ধও হলো, আর স্পার্টানরা এশীয় সেনাবাহিনীর তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী হওয়ায় জয়ও তারাই পেল। কিন্তু আরতাজারেক্সেসের এতে কিছুই হলোনা। বডিগার্ডদের সুরক্ষার ভেতরে থেকে তিনি জীবিতই রইলেন। এটা দেখে সাইরাস প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। আরতাজারেক্সেসই যদি না মরেন তাহলে এই যুদ্ধে জিতে লাভ কী হলো। কোন রকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই তিনি সোজা তার ভাই ও সম্রাট আরতাজারেক্সেসের দিকে চার্জ করলেন। আর্তাজারেক্সেস বডিগার্ডদের সুরক্ষায় ছিলেন, তাকে কিছু করতে হলোনা, বডিগার্ডরাই সাইরাসকে হত্যা করল।
এদিকে গ্রিকরা তো যুদ্ধে জিতল, কিন্তু যার জন্য তাদের যুদ্ধ করা সেই সাইরাসই তো অক্কা পেয়েছে, এখন তাদেরকে পে করবে কে? তারা তাদের দেশের বাড়ি ছেড়ে ১১০০ মাইল দূরে চলে এসেছে, আর তাদের ঘিরে রেখেছে এক শত্রুভাবাপন্ন পারস্য সেনাবাহিনী। এদিকে পারস্য বাহিনীরও হয়েছে আরেক জ্বালা। এই দশ হাজারেরও বেশি শক্তিশালী গ্রিক সৈন্যদেরকে তারা আক্রমণ করার সাহস জোগাতে পারছে না। তখন পারস্যের সত্রপ টিসাফেরনেস এই গ্রিক সেনাবাহিনীর কাছে এলেন। টিসাফেরনেসের সাথে গ্রিকদের সম্পর্ক ভাল ছিল, পেলোপনেসাসের যুদ্ধে তিনি স্পার্টানদের সহায়তা করেছিলেন। এই বিশ্বাসকে ব্যবহার করেই তিনি স্পার্টান জেনারেল ক্লিয়ারকাসের সাথে আলোচনায় যেতে চাইলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে টিসারফেরনেস ছিলেন আরতাজারেক্সেসের সমর্থক ও সাইরাসের বিরোধী। টিসারিফেরনেস ক্লিয়ারকাসকে তার তাঁবুতে আসতে বললেন, যেখানে তার সাথে তিনি যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে আলোচনা করবেন। বেচারা ক্লিয়ারকাস ভাল মনেই রাজি হলেন, তার সাথে আরও চারজন জেনারেলও টিসারফেরনেসের তাঁবুতে প্রবেশ করল। কিন্তু এরপর ঠাণ্ডা মাথায় পারসিকরা এই গ্রিক সেনাপতিদেরকে হত্যা করল। টিসারফেরনেস একেবারে নিশ্চই ছিলেন যে কোন নেতৃত্ব ছাড়া এই সেনাবাহিনী হয় আত্মসমর্পণ করবে, তাতে হয়তো তারা পারস্যের সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে, অথবা তারা নেতৃত্বহীন অনিয়ন্ত্রিত জনতায় পরিণত হবেন যাদেরকে সহজেই পরাজিত করা যাবে। কিন্তু টিসারফেনেসের পরিকল্পনামাফিক কিছুই হলোনা। হলোনা, কারণ এই টেন থাউস্যান্ড এর মধ্যে ছিলেন জেনোফোন নামে এক এথেনীয়। এবার তিনিই এই দশ হাজারের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। তার নেতৃত্বেই এই গ্রিক সেনাবাহিনী তাদের নিজ ভূমি গ্রিসের দিকে ফিরে চলল। কিন্তু আগের ইউফ্রেতিস বরাবর পথ দিয়ে তারা যেতে পারল না, কেননা পারসিকরা সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে তাদেরকে এখন যেতে হবে এক সম্পূর্ণ নতুন ও অচেনা পথ দিয়ে, যার সম্পর্কে তারা কিছুই জানেনা।
তারা উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে তাইগ্রিস নদীর তীরে পৌঁছল, আর তারপর তাইগ্রিস বরাবর উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকল। পথিমধ্যে তারা নিনেভের ধ্বংসাবশেষে পৌঁছল, যা এককালে ছিল শক্তিশালী আসিরীয় সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধশালী রাজধানী। মাত্র দুই শতাব্দী আগে একে ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু এখন এটা এতটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত যে এই স্থানটি আসলে কিসের ধ্বংসাবশেষ তার সম্পর্কে জানতে তাদেরকে আশপাশের লোকজনকে প্রশ্ন করতে হলো। সুদীর্ঘ পাঁচ মাস যাবৎ তারা এগিয়েই চলল। পথিমধ্যে তাদেরকে পারস্যের সেনাবাহিনী ও আদিবাসীদের আক্রমণকেও বারবার প্রতিহত করতে হয়েছে। এভাবে চলতে চলতে অবশেষে ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ফেব্রুয়ারিতে তারা গ্রিক নগর ট্রাপেজাসে (Trapezus) পৌঁছল, যার পরেই ছিল কৃষ্ণসাগর। গ্রিকরা ছিল সামুদ্রিক জীবনে অভ্যস্ত। তাই যে গ্রিক ব্যক্তিটি পারস্য সাম্রাজ্যের হাজার মাইলের কঠোর ও রুক্ষ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে তার কাছে সেটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই ছিলনা, সেই ব্যক্তি যদি এতদিন পর হঠাৎ করে সমুদ্র দেখতে পায় তাহলে তার আনন্দেরও আর বাঁধ থাকেনা। তারা “থালাসা! থালাসা!” (বা “সাগর! সাগর!”) বলে চিৎকার করতে করতে সমুদ্র তীরের দিকে ছুটে গেল।
জেনোফোনের অভিযান সমাপ্ত হলো। তিনি ফিরে এলেন তার স্বদেশভূমি এথেন্সে। কিন্তু ফিরে এসে তিনি কী দেখলেন? দেখলেন, যে এথেনীয় গণতন্ত্রকে তিনি এতদিন শ্রদ্ধা করে এসেছেন, যে এথেনীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য তিনি শপথ নিয়েছিলেন সেই গণতন্ত্রই তার প্রিয় গুরু সক্রেটিসকে হেমলক পান করিয়ে হত্যা করেছে। এই ঘটনা তার মনকে এথেনীয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিঁষিয়ে দিল। তাই সতীর্থ প্লেটোর মত এথেনীয় গণতন্ত্রে বিতৃষ্ণ হয়ে তিনিও এথেন্স ত্যাগ করলেন। কিন্তু প্লেটো যেমন হতাশ হয়ে আবার এথেন্সে ফিরে এসে একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি তা করেননি। জেনোফোন আর কোনদিনই এথেন্সে ফিরে আসেননি। তিনি পুরোপুরি স্পার্টান হয়ে যান। তিনি স্পার্টানদের সাথেই থাকতেন, এমনকি স্পার্টানদের হয়ে এথেন্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করতেন। তিনি টেন থাউস্যান্ড বা দশ হাজার গ্রিক সৈন্যের সেই অভিযানের কাহিনী নিয়ে একটি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটি “অ্যানাবেসিস” (Anabasis) নামে পরিচিত। অ্যানাবেসিসের অর্থ হচ্ছে আপ-গোয়িং, অর্থাৎ চড়াই পথে গমন। গ্রিক অঞ্চল ছিল সমুদ্র তীরবর্তী তাই এই অঞ্চল ছিল নিচুতে, আর পারস্য অঞ্চল ছিল পাহাড়ময়, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পারস্যের ভূমি তুলনামূলভাবে উঁচুতে। তাই গ্রিস থেকে পারস্যে যাবার পথ ছিল চড়াই এর পথ। আর তাই জেনোফোনের এই গ্রন্থের নাম দেন অ্যানাবেসিস। মিলিটারি হিস্টোরি বা সামরিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই গ্রন্থটি হলো একটি ক্লাসিক।
তবে জেনোফোন শুধু এই অ্যানাবেসিসই রচনা করেননি। আমরা জানি, পেলোপনেসাস যুদ্ধের ইতিহাস রচনা করেছিলেন জেনোফোনের মতই আরেক এথেনীয় (বা প্রাক্তন এথেনীয়) জেনারেল থুকিডাইডিস। প্রাক্তন-এথেনীয় বললাম, কেননা তাকেও এথেন্স ত্যাগ করতে হয়েছিল, তবে জেনোফোনের মত স্বেচ্ছায় নয়, নির্বাসনদণ্ড নিয়ে। এই থুকিডাইডিসই রচনা করেছিলেন পেলোপনেসীয় যুদ্ধের পক্ষপাতদুষ্টতাহীন, বস্তুনিষ্ঠ ও অলৌকিকতা-পুরাকথাহীণ ইতিহাস। এরপূর্বে হেরোডোটাসও ইতিহাস রচনা করেছেন, কিন্তু তার রচনা অলৌকিকত্ব ও পুরাকথা থেকে মুক্ত ছিলনা। থুকিডাইডিসই প্রথমবারের মত তা করে দেখান। কিন্তু থুকিডাইডিস পেলোপনেসীয় যুদ্ধের সম্পূর্ণ ইতিহাস লিখে যেতে পারেননি। পেলোপনেসীয় যুদ্ধ চলেছিল ৪৩১ থেকে ৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২৮টি বছর। থুকিডাইডিস ৪১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ অব্দি যুদ্ধের ইতিহাস রচনা করেই মারা যান। ৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত যুদ্ধের অবশিষ্ট ইতিহাস রচনা করে থুকিডাইডিসের কাজটি সমাপ্ত করেন আরেক প্রাক্তন এথেনীয়, এই জেনোফোন। তবে তার রচনা থুকিডাইডিসের মত নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ ছিলনা। পেলোপনেসীয় যুদ্ধ কেবল নগর এথেন্সের বিরুদ্ধে নগর স্পার্টার যুদ্ধ ছিলনা। এই যুদ্ধ একই সাথে ছিল দুই শাসনপদ্ধতির যুদ্ধ, ছিল স্পার্টান গোষ্ঠীতন্ত্রের বিরুদ্ধে এথেনীয় গণতন্ত্রের যুদ্ধ। যুদ্ধে যে অঞ্চল স্পার্টা জিতত সেই অঞ্চলে তারা তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করত, আর যে অঞ্চল এথেন্স জিতত সেখানে এথেন্স তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করত। অধিপতি নগররাষ্ট্রের শাসনপদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার আধিপত্যের নিশ্চয়তার উপায়, আর বিজিত নগররাষ্ট্রের দ্বারা বিজয়ী নগররাষ্ট্রের শাসনপদ্ধতি গ্রহণ ছিল বিজয়ীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যম। যে এথেনীয় গণতন্ত্র জেনোফোনের হৃদয়কে বিঁষিয়ে দিয়েছিল তার ইতিহাস তিনি নিরপেক্ষ হয়ে রচনা করতে পারেননি। তার লেখনি ঝুঁকে যায় স্পার্টা ও স্পার্টার গোষ্ঠীতন্ত্রের দিকে। তিনি ইতিহাস দিয়ে ঋণী করেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই ইতিহাসে আমরা এথেনীয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ও স্পার্টান গোষ্ঠীশাসনের পক্ষে পক্ষপাতদুষ্টতা দেখি। কিন্তু তবুও জেনোফোনের লেখা এই ইতিহাস আমাদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। কারণ তার এই রচনাটি ছাড়া সেই দিনগুলোর বিবরণ নিয়ে আর কোন ভাল রচনা নেই।
[লেখাটি কিছুটা আইজ্যাক আসিমভের The Greeks : A Great Adventure বইটার Ten Thousand অংশের আলোকে লেখা (চতুর্থ সংস্করণে পৃ. ১৬৭–৭০), বাকিটা আমার নিজের বক্তব্য।]
আপনার মতামত জানানঃ